চট্টগ্রাম, ২১ আগস্ট, ২০২২:
আজ ভয়াবহ ২১ আগস্ট, ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার সেই দিন। বর্বর গ্রেনেড হামলায় সেদিন নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মি।
সেদিন বিকাল বেলা রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে মূলত বর্বর নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালানো হয় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে। ১৩ টি শক্তিশালী গ্রেনেড বিস্ফোরণে সভাস্থল হয়ে উঠেছিল এক দানবীয় বিভীষিকাক্ষেত্র। নিহত ও আহত মানুষের ছিন্নবিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যেঙ্গের ছড়াছড়ি, বিশাল এভিনিউ জুড়ে রক্তের নহর, স্তূপ স্তূপ রক্ত আর মাংসের ছড়াছড়ি, আহত, নির্জীবপ্রায়, আতঙ্কিত মানুষের ভয়ার্ত চাহনি, কান্না, আহাজারি, আর্তনাদের এক বিভীষিকা।
সেই বিভীষিকার ময়দান জুড়ে গ্রেনেড আক্রমণের এমন রূপ এর আগে কখনো বাংলাদেশ দেখেনি। প্রকাশ্যে দিনের আলোয় এই নৃশংস আক্রমণ যেন ৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালো রাতের বিভীষিকার চেয়ে ভয়ঙ্কর। কিন্তু গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মি নিহত হলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান আওয়ামী লীগের সভাপতি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ মানববর্ম তৈরি করে শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে সক্ষম হন।
সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার প্রতিবাদে সেদিন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ডাকে সমাবেশ আয়োজন করা হয়। সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশ শেষে নির্ধারিত ছিল একটি মিছিল হবে। মিছিলের নেতৃত্বে থাকবেন শেখ হাসিনা।
যে কারণে সমাবেশে ট্রাকের মঞ্চে কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যের পর শেখ হাসিনা বক্তব্য দিতে শুরু করেন। বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে তিনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ করেন। তিনি হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগোচ্ছিলেন ট্রাক থেকে নামার সিঁড়ির দিকে। এমন সময়েই শুরু মুর্হুমুহু গ্রেনেড হামলা। প্রকম্মিত হয়ে উঠে সমস্ত এলাকা। দানবীয় বিস্ফোরণে আহত , ভয়ার্ত মানুষ দিকবিদিক ছুটতে থাকে। বিকট শব্দে বিস্ম্ফোরিত হতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হলো মৃত্যুপুরীতে। রক্তের নদী বঙ্গবন্ধু িএভিনিউ জুড়ে। নেতাদের মানববর্মে হাসিনা বেঁচে গেলেও তার গাড়িতে উঠার সময় তার উপর আবার গুলি চালানো হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে হত্যার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে ঘাতকচক্র তার গাড়ি লক্ষ্য করে ১২টি গুলি ছুড়েছিল।এভাবে দলের নেতাকর্মী ও দেহরক্ষীদের আত্মত্যাগে বেঁচে যান আহত হয়ে। মৃত্যুর এক ভয়াল ছিন্ন করে তিনি বেরিয়ে আসেন শেখ হাসিনা প্রাণ নিয়ে। যিনি আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রায় টানা সাড়ে তের বছর।
১৮ বছর আগের ২১ আগস্ট, শনিবার ভয়াবহ এই কালো দিনের বার্ষিকীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে ২১ আগস্টের শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা ও আহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
সেদিন যে ২৪ জন শহীদ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে আড়াল করে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে ঘটনাস্থলেই জীবন বিলিয়ে দেন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ। গ্রেনেডের স্প্নিন্টারের আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন নিহত হন আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান। নিহত হন আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ সেন্টু, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), ঢাকা মহানগরের ৫৮ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুফিয়া বেগম, ১৫ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হাসিনা মমতাজ রীনা, মহিলা আওয়ামী লীগ কর্মী রেজিয়া বেগম, জাতীয় শ্রমিক লীগ কর্মী নাসির উদ্দিন সর্দার, ৩০ নম্বর ওয়ার্ড রিকশা শ্রমিক লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হানিফ, ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক বেলাল হোসেন, যুবলীগ বালুঘাট ইউনিটের সভাপতি ও ক্যান্টনমেন্ট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, হোসেনপুর ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি লিটন মুন্সী লিটু, ৮৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা আতিক সরকার, স্বেচ্ছাসেবক লীগ কর্মী আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ কর্মী ও রি-রোলিং মিল ব্যবসায়ী রতন সিকদার, ছাত্রলীগ কর্মী ও সরকারি কবি নজরুল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মামুন মৃধা, জামালপুর আওয়ামী লীগ কর্মী আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ কর্মী ইছহাক মিয়া, মো. শামসুদ্দিন, মমিন আলী, আবুল কাসেম ও জাহেদ আলী। অপর আরও দুই জন নিহত হয়েছেন যাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
স্প্নিন্টার বিদ্ধ হয়ে শেখ হাসিনার জন্য মানববর্ম তৈরি করেন সাবেক মেয়র মো হানিফ সহ অনেক শীর্ষ নেতা। প্রায় আড়াই বছর অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ তিনি মারা যান ২০০৬ সালের ২৭ নভেম্বর। এভাবে স্প্নিন্টার বিদ্ধ অনেকে মারা গেছেন।
আওয়ামী লীগ এই কালো দিনের জাতিকে জানাতে আজ রবিবার সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেন। এরপর আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতেই বিএনপি-জামায়াত তথা চার দলীয় জোট সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নৃশংসতম এই গ্রেনেড হামলা চালায়।২১ আগস্ট নারকীয় হামলা ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে বিচার করা ছিল সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো হত্যাকারীদের রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এজাতীয় হত্যাকাণ্ড হতে পারে না। খালেদা জিয়ার বক্তৃতাগুলো অনুসরণ করবেন। কোটালীপাড়া বোমা পুঁতে রাখার আগে বলেছিল— আওয়ামী লীগ শতবছরেও ক্ষমতায় আসতে পারবে না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে—শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, বিরোধী দলের নেতাও কোনো দিন হতে পারবে না। এগুলোর তো রেকর্ড আছে।
তিনি বলেন, এই আঘাত হয়ত আরো আসবে সামনে। কারণ যখন আমার আব্বা দেশটাকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখনই তো ১৫ অগাস্ট ঘটেছে। আর আজকেও বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হয়েছে, উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া গ্রেনেড হামলার দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ডালিম ও রশিদ দেশে ছিলেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এই চক্রান্তের সাথে… খালেদা জিয়া তাদেরকে যেভাবেই হোক দেশ থেকে চলে যেতে সাহায্য করে। এটা তো বাস্তব কথা। এবং ডালিম যে ঢাকায় ছিল, রশীদ যে ঢাকায় ছিল, এটাতো অনেকেই জানে।
তিনি বলেন, হামলার পরও যখন খুনিরা দেখল যে তিনি বেঁচে গেছেন, তখন তারা দেশ থেকে পালিয়ে যায়। ছবি: সংগৃহীত
Discussion about this post