চট্টগ্রাম,১৪ এপ্রিল,২০২৩:
বহুদিন বাদে কোন মানুষের মৃত্যু দেখলাম মনে হল! ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মারা যাওয়ার খবর যখন পাই, তখন আমি রাস্তায়। সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে বাসায় ফিরছি। আগারগাঁও অবদি আসার পরেই ফোন এলো গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে – এহসান ভাই, আমাদের বড় ভাই তো আর নাই!
সিএনজিওয়ালাকে বললাম, থামান। ধানমন্ডি যেতে হবে। হকচকিয়ে তিনি বললেন, ধানমন্ডি কই?
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
বলতেই তিনি সিএনজি ঘুরিয়ে শিশুমেলার রাস্তা ধরে আগাতে লাগলেন।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনে নেমে ভাড়া মিটিয়ে উপরে যেতেই আইসিউর সামনে জাফরুল্লাহ ভাইয়ের স্বজনদের ভিড়। আইসিইউর সামনেই দেখা হল গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকির সঙ্গে। সাকি ভাই বললেন, এহসান জাফর ভাইর প্রধান চিকিৎসকের বক্তব্য প্রকাশ করা দরকার। এখনো গণসাস্থ্যকেন্দ্র আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। কিন্তু ফেসবুকে তো নানারকম বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ছে। সাকি ভাই আইসিইউর মধ্যে প্রবেশ করলেন। সেখান থেকে একপ্রকার জোর করেই সামনে নিয়ে এলেন ডাক্তার মোস্তাফিকে। তিনি অত্যন্ত অনিচ্ছা ও গভীর বেদনা নিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেন – আমাদের প্রাণপ্রিয় বড় ভাই আর নেই।
২
মধ্যরাতে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ আইসিইউ থেকে বের করে পাঁচতলায় হলরুমে নেওয়া হল বন্ধু স্বজন ও দর্শনার্থীদের দেখার জন্য। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এক কর্মী লিফটের সামনে জটলা বাধা মানুষ সরানোর জন্য বললেন, আপনারা একটু সরে দাঁড়ান বড় ভাইকে নিতে হবে। পিছনে ঘুরে দেখি মধ্য বয়সি এক স্বাস্থ্যকর্মী স্ট্রেচার নিয়ে আগানোর চেষ্টা করছেন। তার গাল বেয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে আকাশি রেক্সিনের কাভারের স্ট্রেচারে।
৩
রাত পৌনে তিনটার দিকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ মোহাম্মদপুরের আল মারকাজুল থেকে গোসল করিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। হঠাৎ চোখ পড়ল এক সিএনজিওয়ালার দিকে। মনে হল আমি কি ভাড়া না দিয়ে চলে গিয়েছিলাম? প্রায় ৩-৪ ঘন্টা তিনি টাকার জন্য অপেক্ষা করে আছেন? খুবই লজ্জিত মুখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, আপনার ভাড়া দিতে ভুলে গেছি। সিএনজিওয়ালা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ভাড়া আগেই দিয়া গেছেন। কেমন একটা লোক মারা গেল, একটু শেষ দেখার জন্য লাগি খাড়াইছি! ততক্ষণে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানে তোলা হয়ে গেছে। একটু পরেই রওনা হবে বারডেমের হিমাগারের উদ্দেশ্যে। সিএনজিওয়ালার হাত ধরে বললাম, আমি আপনার সিএনজি পাহারা দিচ্ছি, আপনি সামনে গিয়ে দেখে আসেন।
জাফর ভায়ের লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানের কাছ থেকে তিনি ফিরে এলেন শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে। আমার সামনে এসে গলা ছেড়ে বললেন, একটা মানুষ আছিল!
৪
শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে শেষ বিদায়ের আয়োজন চলছে। সারিবদ্ধ হয়ে মানুষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। হঠাৎ লাইনের একটি দৃশ্যে চোখ আটকে গেল। পুলিশের পোশাক পরিহিত একজন নিম্ন পদস্থ পুলিশ কর্তা এসেছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে শ্রদ্ধা জানাতে। তার একহাতে ওকিটকি আর এক হাতে ফুল। রাস্তায় দায়িত্ব পালন করছিলেন, একফাঁকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসে দাঁড়িয়েছেন শোকের মিছিলে।
৫
জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বিদায় জানাতে যে অস্থায়ী শোক-বেদী নির্মাণ করা হয়েছিল, তার পাশেই পেছনে ছোট্ট একটি হাতে লেখা ব্যানারে চোখ গেল। গরিব মুক্তি আন্দোলন! ব্যানার দেখেই বুঝা যাচ্ছে, জাফরুল্লাহ চৌধুরী গরীবেরও বন্ধু হতে পেরেছিলেন।
৬
জানাজার আগে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ছেলে বারিশ চৌধুরী বললেন, আমার বাবার সারাজীবনের ইচ্ছে ছিল দেহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য দান করা হোক। সন্তান হিসেবে, পরিবারের সদস্য হিসেবে আমরা এই আশাটি পূরণ করতে চেষ্টা করেছিলাম। এ জন্য আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ কলেজ ও গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজে দেহ দান করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দুই প্রতিষ্ঠান থেকেই শুনেছি, কেউ নেই যে আমার বাবার লাশে ছুরি লাগাতে পারবেন। সম্মান থেকেই এটি বলা হয়েছে। যখন সম্মান ও ভালোবাসা থেকে বলা হয়েছে কেউ হাত দিতে রাজি নয়, তাই সেটি নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই। তাই কালকে সাভারে গণস্বাস্থ্যে কেন্দ্রে দাফন করব।
শেষকথা : চিকিৎসক, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অগ্রণী সংগঠক, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভূমিকা ও অবদান আমরা নিশ্চয়ই স্মরণ রাখব। কিন্তু সবচেয়ে যেটা জরুরি আমার কাছে মনে হয়েছে, জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে হারিয়ে আমরা সত্যিকারের একজন অভিভাবক, আমাদের বড় ভাইকে হারিয়েছি। গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে আহতদের হাসপাতালে বিনা খরচের চিকিৎসা সেবা থেকে শুরু করে পাশে থাকা, আর্থিক সহায়তার যোগান তৈরি করা মানুষটির অভাব আমরা অনুভব করবো।
তবে, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছ থেকে আমরা তার সাহসীকতার দশ ভাগের এক ভাগও যাতে ধারণ ও প্রকাশ করতে পারি এটাই তার কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। শাসকের চোখে চোখ রেখে সত্য বলার সাহস আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হোক। জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাহস হয়ে আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হোক এই শপথ ও আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে জাগ্রত করার মধ্য দিয়েই তাকে বিদায় জানাতে চাই। সূত্র: Gonoshasthaya Kendra-GK ফেসবুক পোস্ট থেকে
Discussion about this post