ব্যক্তি হিসাবে অত্যন্ত সজ্জন, বিনয়ী ও মার্জিত জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু। তবে রাজনীতিবিদ হিসাবে তাকে মূল্যায়ন করা একটু কঠিন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের হাত ধরেই তার এমপি -মন্ত্রী হওয়া। এর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নন্দিত ছাত্রনেতা। এরশাদের জাতীয় পার্টিই তার রাজনৈতিক জীবনকে পূর্ণতা দিয়েছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। যিনি আজ মারা গেছেন প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব। সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন বাবলু। কয়েকদিন আগে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ব্বিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হন চট্টগ্রামের রাউজানের সন্তান জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু। ছাত্রজীবনেই তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিকাশ লাভ করে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বাবলুর মৃত্যুতে শোক বার্তায় বলেছেন, ছাত্র জীবনেই তার অনুপম নেতৃত্ব প্রকাশ হয়েছিল। বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন ডাকসুর জিএস। মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু সবসময় ছিলেন আপোষহীন। তিনি অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন আজীবন। জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ছিলেন গণমানুষের কন্ঠস্বর। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। তার মৃত্যুতে দেশের রাজনীতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা সহসাই পূরণ হওয়ার নয়। জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করতে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু তার কল্যাণময় কর্মের মাঝে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের একটা কথা বলেছেন, ছাত্র জীবনেই তার অনুপম নেতৃত্ব প্রকাশ হয়েছিল। বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন ডাকসুর জিএস। জি েএম কাদেরের কথার পর যদি বলতে হয় যে ডাকসুর জিএস বাবলু জাতীয় পার্টিতে যুক্ত হলেও রাজনীতিতে তিনি বিশ্বস্থতার জায়গাটি হারান। যখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে।
‘ডাকসু জিএস হয়ে বাবলু যে কাণ্ডে আলোচিত’ লেখাটিতে বিডিনিউজ২৪ডটকম লিখেছে-বাংলাদেশের রাজনীতি এবং ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঘটনায় আলোচিত হয়ে থাকবেন জিয়াউদ্দিন বাবলু।গত শতকের ৮০ এর দশকে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের দলে ভিড়ে গিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন তিনি।
নানা সুবিধা নিয়ে তার সেই পদক্ষেপকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বললেও সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ক্ষতি হয়নি বলে মনে করেন তৎকালীন ছাত্রনেতারা।
প্রবল আন্দোলনেই ১৯৯০ সালে পতন ঘটে এরশাদের, আর তখনও ছাত্র আন্দোলনের নেতারাই ছিলেন মূল প্রভাবকের ভূমিকায়।
সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও বাবলু জাতীয় পার্টিতে এরশাদের বিশ্বস্ত হয়েই ছিলেন। এই দলটির মহাসচিব পদে থাকা অবস্থায়ই শনিবার মারা যান তিনি।
তবে একজন রাজনীতিবিদ িতার রাজনৈতিক সমালোচনার জায়গার পরিসরটা যতটা ব্যাপ্তি পাবে সেক্ষেত্রে তিনি যখন তার ছাত্র আন্দোলনের মঞ্চ থেকে পালিয়ে এরশাদের সাথে ভিড়ে যান সেই থেকে তার রাজনৈতিক মেধায় পরিপুষ্ট হয়েছে জাতীয় পার্টি। মূলত জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু পরবর্তি রাজনৈতিক জীবনে জাতীয় পার্টি ছেড়ে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে অন্তর্ভুক্ত হননি।
১৯৮২ সালের সেই ডাকসুতে সভাপতি ছিলেন মো. আখতারুজ্জামান (বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা)। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জিয়াউদ্দিন বাবলু।
তৎকালীন ছাত্রনেতারা বলেন, সেই ডাকসুর আগে দুইবার ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে জিএস ছিলেন আখতারুজ্জামান। তাদের যে জনপ্রিয়তা বা প্রভাব ছিল, তা বাবলুর না থাকলেও তখন প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন বাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ডাকসুরও জিএস নির্বাচিত হন ইংরেজি বিভাগের ছাত্র বাবলু।
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন পেরুনোর পরই বাবলু সেই কাণ্ড ঘটান।
কী ঘটেছিল তখন- জানতে চাইলে তখনকার ডাকসুর সদস্য এবং বর্তমানে বাসদ নেতা বজলুর রশিদ ফিরোজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এরশাদের বাহিনী ক্যাম্পাসে ম্যাসাকার করল। জাফর, জয়নালরা শহীদ হলেন। পুলিশ-আর্মি শত শত ছাত্রকে গ্রেপ্তার করল, জখম করল।
“এরকম পরিস্থিতিতে সূর্যসেন হলের হাউজ টিউটরের বাসা থেকে বাবলু তার বন্ধু এক মেজরের গাড়িতে করে পালিয়ে যায়। বাবলু ওই হলের আবাসিক ছাত্র ছিল। আর্মির গাড়িতে তার চলে যাওয়া, এটাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে দেখা হল। কারণ সে ছিল ডাকসুর জিএস।”
ফিরোজ বলেন, “যখন ছাত্ররা মার খাচ্ছে, মারা গেছে, তখন ভীরুর মতো আর্মির গাড়িতে এভাবে সে পালাতে পারে না। একটা মিটিংয়ে সে এটা এগ্রিও করে। তখন ডাকসুর জিএস পদ থেকে একটা অব্যাহতিপত্র তার কাছ থেকে নেওয়া হয়। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
“এর কিছুদিন পরও সে দলের সঙ্গে ছিল। একটা পর্যায়ে এরশাদের চার দফা বাস্তবায়ন পরিষদ করে। তখন তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে বাবলু নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ করে।”
ছাত্র আন্দোলনে জেরবার এরশাদ ছাত্রদের মধ্যে তার অবস্থান তৈরিতে নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ নামে একটি সংগঠন গড়েছিলেন। পরে নাম বদলে তা হয় জাতীয় ছাত্র সমাজ। কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে এরশাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি।
বাবুলকে ১৯৮৪-৮৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা করেন এরশাদ, উপসচিবের মর্যাদায়। ১৯৮৫-৮৬ সালে তাকে শিক্ষা উপমন্ত্রী করেন এরশাদ।
এরপর ১৯৮৬-৮৭ সালে বাবলুকে করা হয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী। ১৯৮৭ সালে হন অর্থ প্রতিমন্ত্রী। ওই বছরই বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে তাকে পূর্ণ মন্ত্রী করেন এরশাদ। পরে পেয়েছিলেন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা, ওই সময়কার বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নূর আহমেদ বকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এরশাদের সবসময়কার টার্গেট ছিল ছাত্র আন্দোলনকে দ্বিখণ্ডিত করা। শেষ দিন পর্যন্ত সে এই কাজ করে। ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে রাজনীতিতে ঢোকানো, এসব করেছে।১৯৮৮ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হন বাবলু। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা করা হয়েছিল তাকে।
২০১৪ সালে (চট্টগ্রাম-৯) আসন থেকে দশম জাতীয় সংসদের সদস্য হন বাবলু। একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হতে চাইলেও জোট রাজনীতির কারণে এরশাদের অনুরোধে তিনি ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ান।
২০১৪ সালে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে এরশাদ জাতীয় পার্টির মহাসচিব করেন বাবলুকে। ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
তবে বাবলু ২০১৩ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। মূলত এসময়ে আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির একটি সম্পর্কের সূত্রপাতও করেন জিয়াউদ্দিন বাবলু সহ জাতীয় পার্টির অন্য নেতারা। এ সময় চট্টগ্রামের রাজনৈতিক মাঠে বিচরণ করেন জিয়াউদ্দিন বাবলু।
জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলুর জন্ম ১৯৫৪ সালের ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের রাউজানের কদলপুরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। মা- নুর মহল বেগম। বাবা- ডা. আবুল কাশেম। শিক্ষা : এসএসসি- সরকারি পাইলট হাই স্কুল, ফেনী ১৯৬৯; এইচএসসি- নটরডেম কলেজ, ঢাকা, ১৯৭২; বিএ (অনার্স)- ইংরেজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৭ এমএ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৮; এলএলবি- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮১।
পেশা : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, জারা কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস ও আশিক গার্মেন্টস লিঃ।
সাংগঠনিক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট সদস্য, ১৯৮০- ৮৩। সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু), ১৯৮২-৮৩। সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগ ছাত্র সমিতি ১৯৭৪-৭৫। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলারের ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা ১৯৮৪-৮৫।
পরিবার: ১৯৮৩ সালে ফরিদা সরকারের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ। জিয়াউদ্দিন বাবলুর প্রথম স্ত্রী অধ্যাপক ফরিদা আক্তার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৫ সালে মারা যান। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল এরশাদের ভাগ্নি মেহেজেবুন্নেসা টুম্পাকে বিয়ে করেন বাবলু। ড. আসাদুর রহমান ও মেরিনা রহমানের মেয়ে টুম্পাও বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেন।
বাবলু ফার্স্ট কমিউনিকেশন লিমিটেড ও হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্টারন্যাশনাল নামে দুটি প্রতিষ্ঠানেরও চেয়ারম্যান ছিলেন।
তবে জাতীয় রাজনীতিতে জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলুর যেমন ব্যাপক অবদান রয়েছে, তেমনি চট্টগ্রামের সন্তান হিসাবে চট্টগ্রামের সাথে তার সম্পর্ক অটুট ছিল। যে কারণে চট্টগ্রামের দুটি আসন থেকে তিনি দু’ দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়া্ চট্টগ্রামের সন্তান হিসাবে চট্টগ্রামের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বর্ণাঢ্য ছিল তার রাজনৈতিক জীবনও।
Discussion about this post