পকিস্তান সরকারে অধীনে যে অফিসাররা অ্যাদ্দিন বশংবদের মত কাজ করছিল, তাদের চাকুরির সব সুযোগ-সুবিধা সিনিয়রিটি ইত্যাদি অব্যাহত রেখে বাংলাদেশ সরকারি কাজে পুনর্বহালের যে-দিন সিদ্ধান্ত হয়, সেইদিনই হল মুজিবের রাহুগ্রাসের সূচনা।
রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশগুলোর কেউই পরাভূত সরকারের সামরিক বা অসামরিক ব্যক্তিদের ঢালাওভাবে নয়া সরকারে নেয় না। সে ফিডেল কাষ্ট্ৰো বা মাও সে-তুঙ, যিনিই হোন বিপ্লবী প্রকারের বৈপ্লবিক নীতি-কর্ম রূপায়ণে উপযুক্ত নতুন লোক নিয়েই তাঁর অভিযাত্রা শুরু করেন। তাই একদিকে তাঁরা পারেন পরাভূত শত্রুর অবশিষ্ট চরদের পরবর্তী ষড়যন্ত্রসমূহ বানচাল করতে, অপরদিকে পারেন নিজেদের লক্ষ্যের দিকে স্থিরভাবে এগোতে। কেউ কেউ এজন্য চরম নির্মমতা দেখাতেও কুণ্ঠা বোধ করেন না। কম্বোডিয়ার বিপ্লবী সরকার নাকি এ জন্য পাঁচ হাজার অফিসারকে খতম করে দিয়েছে।
কিন্তু বিচিত্র এই বাংলাদেশ। পূর্বেকার অভিজ্ঞ লোকদের না-হলেই না- কি চলবে না নয়া সরকার। ইত্তেফাকের মতে কাগজগুলো তো এই যুক্তিতেই তদ্বির শুরু করল। কিন্তু কিসের অভিজ্ঞতা? দুর্নীতির, পাকিস্তানের চরবৃত্তি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, গণহত্যার সহায়তার।
খোন্দকার চক্রের তৎপরতায় কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ সরকারের হেড কোয়ার্টার ইডেন বিল্ডিংস-এ সেই পরিচিত গোঁপগুলো আবার দাঁড়া নাড়তে লাগল। মুক্তিফৌজকে ভেঙে দেওয়া হল তাদের প্রথম কাজ। বলতে লাগল, যুক্তিবাহিনীর ছোকরাদের জব্দ না করতে পারলে ওরা যে-ভাবে বেড়ে উঠেছে, তাতে ভবিষ্যতে আইন-শৃঙ্খলা থাকবে না কিছু। দেশপ্রেমিক এই তরুণরা এদের চিরশত্রু হবে এটা স্বাভাবিক।
একটি ঘটনার কথা আমার এই সূত্রে মনে পড়ছে। তিয়াত্তরের প্রথম দিক। এক বিকেলে আমি আর কয়েকজন সাংবাদিক বঙ্গভবনের ব্যালকনিতে মুজিবের সঙ্গে কথা বলছি। সামনে সবুজ লনে অস্ত সূর্যের রঙ। মুজিব তার সাম্প্রতিক যশোর সফরের একটি বিশেষ কাহিনি শোনালেন। মিটিং সেরে আমি সার্কিট হাউসে ফিরে আসছি। লোক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে নামতেই জয় বাংলা, বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হল। আমি এগিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ একজন এগিয়ে এসে সালাম করল আমাকে ৷ কে? মুখটা যেন চেনা-চেনা! নির্মল না?
হ্যাঁ, সেই নির্মল। তেত্রিশ বছর আগে আমরা গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে খেলতাম। তাঁকে জড়িয়ে ধরে ঘরের মধ্যে নিলাম। নির্মল ছিল আমাদের স্কুলের ফুটবল টিমের সেন্টার-হাফ। এই যশোরেই ফাইনাল খেলতে এসেছিলাম। দারুণ খেলা হয়েছিল। তীব্র প্রতিদ্বন্ধিতার মধ্যেও সেদিন আমরো জিতেছিলাম এই নির্মলের জন্য। অতীত স্মৃতি নিয়ে শুরুতে কথা হতে থাকল। এক সময় আমিই জানতে চাই, তা এখন কী করছ ? নির্মল বলল, পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলাম, এখন অবসরপ্রাপ্ত।
আমার খটকা লাগল।- তোমার তো রিটায়ার করার বয়স হয়নি?
সে বলল, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমি ছিলাম এই জেলারই একটি থানার সেকেন্ড অফিসার।
চীফ ইন্সপেক্টর হল জামাত দলের সমর্থক। সে আমাকে চাকরি থেকে তাড়াবার এক হীন ষড়যন্ত্র করে। আমি যখন জানতে পারি, আমি মুজিবনগরে পালিয়ে যাই। যুদ্ধের নয় মাস সেখানেই কাজ করি। যুদ্ধের পরে ফিরে এসে কাজ পেলাম সেই ষড়যন্ত্রকারী অফিসারের অধীনেই। এবার আমার মনোবল ভেঙে গেল। পদত্যাগ করলাম। আগে জীবনে তো বাঁচি। বঙ্গবন্ধু বললেন, শুনেই আমি ডিআইজিকে তলব করলাম। বললাম, একে প্রমোশন দিয়ে দিন। নির্মল প্রায় আমার পা ধরে ফেলল— মাফ চাইছি, প্রমোশন চাই না। ইন্সপেক্টর আমাকে যে কোনোভাবে হোক শেষ করবে। তবে হ্যাঁ, যদি অন্য কোনো জেলায় দেন, কাজ করব। বললেন, নির্মলকে আমি বরিশালে বদলির নির্দেশ দিয়েছি।
কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, জান বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়া কঠিন কাজ; কিন্তু একবার চড়ে বসলে তার পিঠ থেকে নামা আরও কঠিন। হয় তুমি বাঘকে বাগ মানিয়ে রাখবে, না হয় বাগে পেলে সে তোমার খেয়ে ফেলবে। মাঝামাঝি কোনো উপায় নেই।
আবার চুপ। বললেন, এবার আমায় বলো, আমার প্রশাসনে কোথায় ত্রুটি।
সাংবাদিক গাফ্ফার চৌধুরী এবার মুখ খুললেনা গোস্তাকি মাফ করবেন স্যার, আপনার দিলটা হল শের-এ বাঙ্গাল ফজলুল হকের মতে মায়ের হৃদয়। আপনি যদি শাহান শাহ আওরঙ্গজেবের মত নির্মম হতে পারতেন অনেক কাজ করতে এদেশে। আর একজন সাংবাদিক এবার ভরসা পেয়ে বলল, তাদের প্রতি দয়া দেখাচ্ছেন, আপনি ভেবে দেখছেন না, স্যার। ওরা সব বিষাক্ত সাপ।
এবার মুজিব চেচিয়ে উঠলেন- তোমরাই তে আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কেন আমাকে ‘জাতির পিতা’ বানালে?
পাইপটা টেবিলে ঠুকে রেখে দিলেন মুজিব। তারপর বললেন, দেখ, একটা কথা বলে বাখছি। চিলিতে ওরা আলেন্দেকে শেষ করেছে। কিন্তু অত সহজে আমাকে সরানো যাবে না। নিজ থেকে যদি আমি কখনো সরে আসতে চাই, তখন সেনাপ্রধানরা এসে বলবে, এতদিন আপনি সরকার চালিয়েছেন। এখন ক্লান্ত। এই কাগজে সই করুন। চিরদিন আপন জাতির পিতা হয়ে থাকবেন। এভাবেই তারা আমার সইটি বাগাবে। তারপর কী হবে বুঝবে। তোমাদের মত জাতীয়তাবাদীদেরই আগে জবাই দেবে তারা। তখন আমার মূল্য বুঝবে যখন আমি থাকব না। এখন সবাই চালার তলায় আছে। চালাখানা না থাকলে বুঝতে পারবে বাইরের তুফান কী ভয়ংকর ভাবে আক্রমণ করে।
কিছুদিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব হেনরি কিসিঞ্জার ঢাকা এলেন সফরে। বাইশঘণ্টা মাত্র রইলেন। গণভবনে যে সাংবাদিক সম্মেলন করেন, সেখানে সীমাবদ্ধ কয়েকটি কথা বললেন। কিন্তু যে কটি কথা,
তা কেবল মুজিবের প্রশংসা। তাজউদ্দীনের প্রস্থান ও কিসিঞ্জারের মুজিব প্রশস্তি কেমন যেন তাৎপর্যময় মনে হয়েছিল সেদিন অনেকের।
তাজউদ্দিনের বাড়িতে বসে একদিন কিসিঞ্জারের ঢাকা-সফর নিয়ে কথা হচ্ছিল। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ঢাকার সংবাদদাতা কিরীট ভৌমিকও সেখানে ছিল সেদিন। দেখলাম, ব্যাপারটা তাজউদ্দীনের খুব লেগেছে। তিনি ক্ষুব্ধ। বললেন- আমাদের বিদেশমন্ত্রক এবং মার্কিন দূতাবাস থেকে দু’দুটো পার্টি দিল কিসিঞ্জারের সম্মানে। পার্লামেন্টের সকল সদস্যই আমন্ত্রিত ছিলেন, বাদ দেওয়া হয়েছে কেবল আমাকে। বলতে গিয়ে কন্ঠস্বর কেঁপে যাচ্ছে তাজের। বললেন দেখ, আমাকে বাদ দিয়েছে ওরা বেশ করেছে, কোনো দুঃখ নেই তাতে। আমি জানি, কলকাতা থেকে আমরা যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চালাচ্ছি , তখন ওই কিসিঞ্জারই পানিস্তানকে সাহায্য ও সমর্থন দিয়েছে। তবুও একবার আমার কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিল। তাকে শুধু বলতাম- দেখে যান, আপনাদের সকল বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।
দুর্ভিক্ষ দেখা দিল বাংলাদেশে। আমেরিকার প্রতিশ্রুত খাদ্য যথাকালে পৌছল না। না খেয়ে মরতে লাগল হাজার হাজার বাঙালি। মুজিব বুঝল, এভাবেই নাস্তানাবুদ করে আমেরিকা তাকে তাদের হাতের পুতুল বানাতে চায়। সব বুঝেও তিনি তখন অসহায়। হাজার হাজার প্রাণ দুর্ভিক্ষের গ্রাসে শেষ হয়ে যাচ্ছে, চোখের ‘পরে দেখতে হল মুজিবকে। অথচ আশ্চর্য, তবু ওরা মৃত্যুর অগেও অভিশাপ দিচ্ছে না ওদের বঙ্গবন্ধুকে। চোখের জল রাখতে পারছেন না মুজিব। রংপুর ত্রাণ শিবিরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন জাতির পিতা।
এ সময় কিছু বিদেশি সাংবাদিক এসে গেল বাংলাদেশে। তারা দেশে বার্তা পাঠালো মুজিব সরকার ব্যর্থ হয়েছে।হাজার হাজার নরনারী যখন দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে মৃত্যুবরণ করছে, তখন লক্ষ লক্ষ ডলারের বিদেশি সাহায্য দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসাররা লুটেপুট স্ফূর্ত্তি করছে।
উদ্দেশ্যটা একই। বাইরে মুজিবের ভাবমূর্তিটায় কালি ছিটানো। কেউ ওদের জবাব দিল ন যে- বাপু, যা দিচ্ছি বলে ঢাক পেটাচ্ছে, তা তো হাত ঘুরিয়ে নিয়েই নিচ্ছ ফের। মোট সাহায্যের শতকরা আটত্রিশ ভাগই, চলে
যেত ওইসব দাতাকর্নদের বিমান ভাড়া, কর্মীদের রাহা খরচা এবং ত্রাণ সেবকদের থাকাখাওয়া গাড়ি-চড়ার বাবদে। বাদবাকি যা, তারও শতকরা পনের ভাগ অব্যবহার্য। যেমন, বাংলাদেশের মেয়েদের তখন পরবার শাড়ি
পর্যন্ত নেই। ওরা পরবার জন্য পাঠালো স্কার্ট, গাউন, বিকিনি। বাংলাদেশের গ্রামের মেয়ে-বউ চায় শাড়ি!
এই শাড়ি কেনার ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে এক তিক্ততা ঘটল আশ্চর্যভাবে। ভারত থেকে শড়ি কেনার জন্য ঢাকায় ভারতের হাইকমিশন সুবিল দত্তের উদ্যোগে পাঁচ কোটি টাকা অনুদান মঞ্জুর করল ভারত সরকার। ঢাকার একদল সিনিয়র অফিসার এসে কলকাতা, বোম্বের মিলগুলি দেখল। তারা শাড়ির বদলে কিনল বড় বড় গামছা। ঢাকায় প্যাকেটগুলো পৌঁছলে ভারতের ‘পর চটে গেল সবাই। এটা যেন ভারতেরই কারসাজি। মুজিব ভারত সরকারকে অভিযোগ জানালেন। তলব করা হল সুবিমল দত্তকে। ষড়যন্ত্রটা ফাঁস হল।
কিন্তু ঐ নিয়েই এদিকে মৌলানা ভাসানী ভারতের বিরুদ্ধে জোর জিগির তুললেন। অথচ এই লোকটিই নয় মাস বেশ বিলাসবহুল ব্যবস্থায় কাটিয়ে গেছেন কলকাতায়। যথেষ্ট তোয়াজে রাখা হয় তাকে। মৌলানার
হাওয়া বদল দরকার তাই বিমান বাহিনীর একখানি বিমান তাকে দেওয়া হয় নৈনিতাল, মুসোরি এবং দেরানুন যাতায়াতে। ঢাকা মুক্ত হওয়ার তিন সপ্তাহ পরে নির্ঝঞ্ঝাটে তিনি ফিরে আসেন। টাঙ্গাইলে নিজের বাড়ি পৌঁছে ভাসানীর মাথায় হাত। তার ঘর গুড়িয়ে দিয়ে গেছে পাকিস্তানি সৈন্য।
ইতোমধ্যে সুবিমল দত্ত ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার নিযুক্ত হয়েছেন। হঠাৎ টাঙ্গাইল থেকে ভাসানীর এক চিঠি। তিনি সুবিমলবাবুকে টাঙ্গাইলে গিয়ে তর সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করেছেন। সুবিমলবাবু ভাসানীকে উত্তরে জানালেন, অফিসের কাজে ঢাকায় তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত। যদি তিনি বলেন, একজন পদস্থ অফিসার পাঠানো যেতে পারে। ভাসানী তাতেই রাজি হলেন। সুবিমলবাবু তখন হাইকমিশনের উচ্চপদস্থ অফিসার চন্দ্রশেখর দাশগুপ্তকে পাঠালেন। এটা বাহাত্তরের মার্চ মাস।
মৌলানা সাহেব চন্দ্রশেখরবাবুকে বললেন, পাকিস্তানি সৈন্য তার বাড়িঘর মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। এখন তাঁর অন্তত হাজার চল্লিশেক টাকা নগদ এবং বস্তা তিরিশেক সিমেন্ট ও কিছু লোহালক্কড় না হলেই নয়। ভারত
সরকারের কাছ থেকে এটা পাইয়ে দিতে হবে। কুটনৈতিক বাধা-নিষেধের জন্য দাশগুপ্ত সরাসরি কিছু বলতে পারলেন না। তিনি এসে সুবিমল দত্তকে জানালেন।রররর বিশেষকে ভারত সরকার ঐরকম কেনো টাকাকড়ি জিনিশপত্তর দিতে পারে না। তবে যদি বাংলাদেশ সরকার বলে, ভারত সরকার বিবেচনা করে দেখতে পারে। সুবিমলবাবু তার এই চিঠির অনুলিপি বাংলাদেশ বিদেশমন্ত্রকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
ভাসানীর গোঁসা হল। ওই দিন থেকেই মৌলানা সাহেবের ভারতবিরোধী জেহাদ শুরু। – ভাসানীর এই অপ-অভিযানের বিষয়ে আমি বাহাত্তরের এপ্রিলে একদিন শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেছিলাম। শেখ সাহেব বললেন, ওই বৃদ্ধকে গ্রেপ্তার করে আমি তাকে শহীদ বানাতে চাই না।
উনিশ শ’ পঁচাত্তরের পয়লা জানুয়ারি বাংলাদেশ জরুরি অবস্থা ঘোষিত হল। পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করে সেখান থেকে নগদ সাহায্য আনা, দেশে ল্পোন্নয়নে ও কৃষি ক্ষেত্রে আরও গুরুত্ব আরোপ করা। খাদ্যের জন্য বাফার স্টক রাখা- এসব উদ্দেশাকে সফল করতে এবং প্রশাসনকে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী চাঙ্গা করতেই মুজিব জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন।
কিন্তু দেশের মধ্যে বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজ ভালো চোখে দেখল না এটা। এদিকে শিল্পক্ষেত্রে পুঁজিপতিদের ষড়যন্ত্রে কিছু করতে পারা গেল না। সমস্যা রয়েই গেল। সেই সঙ্গে যত দোষ নন্দঘোষ, অর্থাৎ ভারতের বিরুদ্ধে এমনি একটা বিদ্বিষ্ট প্রচারও চলতে লাগল বিশেষ চক্র থেকে। শেখ সাহেবও তা মর্মে মর্মে বুঝলেন।
মুজিব যে একদলীয় শাসন কায়েম করলেন, তার পিছনে অনেকগুলি কারণ ছিল। চুয়াত্তরে প্রেসিডেন্ট নিক্সেনের পদত্যাগের পরই মুজিব ওয়াশিংটন পৌঁছলেন। প্রেসিডেন্ট ফোর্ড প্ৰথমে তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই চাননি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের সর্নিবন্ধ অনুরোধে প্রেসিডেন্ট ফোর্ড তার দশটি মিনিট ব্যয় করতে রাজী হন। এতে অপমানিত বোধ করেন মুজিব। ওয়াশিংটন যাত্রার আগে মুজিব এই সম্পর্কে তাজউদ্দীন এবং কামরুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলেন। তারা দুজনেই মুজিবকে জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়ার পরামর্শ দেন। মুজিব তা শুনলেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্ সম্পর্কে এক তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে তাকে দেশে ফিরতে হয়।
এরকম একটা মওকার অপেক্ষাই করছিল সোভিয়েত সরকার। এই সময় ফজলুর হক মনি ছিল শেখ সাহেবের একান্ত উপদেষ্টা। স্বাধীনতার পরই সে দু’দুটো খবরের কাগজের মালিক হয়ে গেলো কী করে। তার ঘনিষ্ঠতা ছিল রুশ দূতাবাসের সঙ্গে। সে-ও এই সুযোগটা নিল। এদিকে বাংলাদেশে মণি সিং-এর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টিও মুজাফফর ন্যাপ তিয়াত্তরের নির্বাচনে একটি আসনও না পেয়ে যে মার খেল, তা থেকে বাঁচার জন্য ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হতে একটি সুযোগ চাইছিল। ওই সব শক্তি তৎপরতায় সফল হল। চার পার্টি মিলিয়ে একদলীয় শাসন কায়েম করলেন মুজিব। ব্যাপারটায় আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা মোটেই খুশি হলেন না। দলের সভায় তারা প্রশ্ন তুলল, সোভিয়েত পন্থীদের এভাবে ভিড়ানো হল কেন? কিন্তু মুজিব তার জবাব দিলেন না।
দেশের বৃহত্তম স্বার্থের নামে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বিলোপ হল। মুজিব তাঁর জীবনের আটাশটি বছর ব্যয় করেছেন এই দলকে গড়ে তুলতে। হাজার হাজার নিষ্ঠাবান কর্মি ও নেতা তৈরি হয়েছে এই দলের মাধ্যমে। এই আওয়ামী লীগই দেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিচালক। তারাই এনেছে দেশের স্বাধীনতা।
এর পরিবর্তে জন্ম নিল বাকশাল। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মুজাফফর), সিপিবি, যুবলীগ , শ্রমিকলীপ, কৃষকলীগ, এমনকি ছাত্রলীগও এসে মিশে গেল ‘বাকশাল’-এ। ছাত্র থেকে সামরিক অফিসার-সবাই বাকশাল। সরকার যখন ঘোষণা করল টাঙ্গাইলের সন্তোষে ইসলাামিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে ভাসানী মৌলানা সেদিন মোবারক জানালেন নয়া দলকে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এই নতুন দলে তাঁরা যোগদানের কথা ঘোষণা করলেন। সাড়ে তিনশ সাংবাদিকই গণভবনে ছুটে গেলা বাকশালের সভায়। ঢাকার পত্রিকগুলি ঢাক পেটাতে লাগল। পার্লামেন্টের সদস্যরা সবাই এসে লাইন ধরল। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়ে শোকরিয়া জানাল স্যাঙ্গাতদের। সে এক এলাহী ব্যাপার চলল।
দূরে রইলেন শুধু একজন তাজউদ্দীন। আর একজন তাজের সঙ্গে যিনি ছিলেন সংবিধানের অন্যতম রচয়িতা, সেই বিদেশমন্ত্রী কামাল হোসেন নীরবে এই দৃশ্য দেশে চলে গেলেন অক্সফোর্ডে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে। আর এক সাংবদিক আবদুস গাফ্ফার চৌধুরী মুজিবের এই কাজের সমালোচনা করে লন্ডন পাড়ি দিলেন।
একশ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির উপরে তের জন সদস্য নিয়ে হল বাকশাল পলিটব্যুরো। দল, সংসদীর সংস্থা, মন্ত্রিসভা ইত্যাদি সব ছাপিয়ে সর্বশক্তিমান হল এই পলিটব্যুরো। স্বাধীনতার পর তিনি দু’দুটি সংবাদপত্রের
মালিক হয়েছিলেন। এ থেকে যারা বাদ পড়ল, স্বভাবতই তারা এই নিয়ে মুজিব বিরোধী ঘোঁট পাকাতে লাগল। এদিকে একদলীয় শাসন কায়েম করেই মুজিব হাত দিলেন প্রশাসনকে পুরো ঢেলে সাজানোতে। গোটা দেশ বিন্যস্ত হল বাষট্টি জেলায়। জেলাপ্রশাসনের মাথায় একজন করে গভর্নর। দু’শো বছরের পুরানো প্রশাসন কাঠামো পুরো ভেঙ্গে দেয়া হল। গভর্নররা ক্ষমতাধর হয়ে গজিয়ে উঠল নতুন করে। শহরকেন্দ্রিক ক্ষমতা চলে গেল বাইরে। শহরের সুবিধাভোগী সমাজ, মধবিত্ত, শিক্ষিত মানুষদের রোষানলে পড়লেন এতে মুজিব। চটে গিয়ে মুজিব ঢাকার এক সমাবেশে শহুরেদের আক্রমণ করলেন তীব্র ভাষায়। আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল। ফলে ক্ষমতাচক্রের বাইরের রাজনীতিক ঘুঘুরা, সুযোগ হারানো সুবিধাবাদী শহুরে, সবাই একজোট হল মুজিবের বিরুদ্ধে। । এমন একটা মওকার জন্য অপেক্ষা করছিল কোনো কোনো বিদেশী শক্তি। তারা হাত বাড়িয়ে দিল এবার। কলকাঠি নাড়তে শুরু করল মুজিব সরকারের পতন ঘটাতে।
#লেখক ও সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের জন্ম ১৯৩৯ সালে, বাংলাদেশের বরিশাল জেলার ঝালকাঠিতে। ১৯৫০-এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষিতে তাদের পরিবার ভারতে চলে যায়। সুখরঞ্জন পড়াশুনা করেছেন কলকাতাতেই, সাংবাদিকতায়। এছাড়া যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৯৬৪ সালে, কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায়। “মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র” বইটি বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ওপর রচিত প্রথম বই। এই লেখাটি সেই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় পোর্টসিটি লিঙ্কের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল। ‘মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা’ নামে, এই বইটি বাংলাসহ ছ’টি আঞ্চলিক ভাষায় প্রকাশিত
হয়। ইংরেজি সংস্করণটি প্রকাশক করেছিল দিল্লির ইউবিএস। আর বাংলায় ‘মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র’ প্রকাশ করে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স।” বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে যত বই প্রকাশিত
হয়েছে তার মধ্যে এই বইটি অনন্য। একাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত দীর্ঘ ৪ বছর ঢাকায় থাকার সুবাদে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল।
Discussion about this post