চট্টগ্রাম, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩:
হানাস সাপ, চট্টগ্রামে এটিকে ‘হানি হাপ’ বলা হয়। বাংলাদেশের অন্য সব অঞ্চলে অন্যান্য বিষধর সাপের উপদ্রব থাকলেও চট্টগ্রামের গ্রাম অঞ্চলে যত্রতত্র এই সাপ দেখা যায়। তবে আকারে বড় হানাস সাপ পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম ও সিলেটে। বড় সাপের দৈর্ঘ্য দুই মিটারের চেয়ে কম হয়।
এটি ইলাপিডি গোত্রের বিষাক্ত সাপ। তবে উত্ত্যক্ত না করলে এটি কামড়ায় না। এটি কালকেউটে বা কাল নাগ হিসাবেও পরিচিত। অঞ্চলভেদে আরো কিছু নাম রয়েছে এটির। বরিশালে কালাঞ্জিরি, চট্টগ্রামে হানাস, উত্তরবঙ্গে জাতিসাপ নামেও ডাকা হয়। শঙ্খিনী জাতের এই সাপকে কালাচ বা কালনাগও বলা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম কমন ক্রেইট।
বাংলাদেশে যে কয়টি সাপের ছোবলে মানুষের মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয়, এটি তার অন্যতম। কারণ এ সাপের দংশন হলে অনেক সময়ই সাথে সাথে বোঝা যায় না।
এই সাপ কালচে রংয়ের ও এদের গায়ে অর্ধ-চন্দ্রাকৃতি সাদা বলয় বা ডোরা আছে। ডোরা বলয়গুলো শুরু হয়েছে ঘাড়ের কিছুটা পেছন থেকে। চোখের সামনে সাদা দাগ, উপরের চোয়াল ও পেট দেখতে সাদা রঙের। এ সাপ ফণা তোলে না। বসবাস করে ইটের খাঁজে, ইঁদুরের গর্ত, পুরনো বাড়ি, খোলা মাঠ, বাগান, বাড়ির ছাদ এবং মানুষের বসতবাড়ি কাছাকাছি। যে কারণে এটি মানুষের চোখে পড়ে বেশি। আড়ালে-আবডালে থাকে বলে মানুষের অসতর্কতায় এটি অনিরাপদ মনে করলে কামড়ে দেয়। যদি সাপটি মনে করে সে আক্রান্তের শিকার হয়েছে। এরা বেশি উপরে উঠতে পারে না।
রাতে খাবারের সন্ধানে বের হয় হানাস। ব্যাঙ, টিকটিকি ও ইঁদুরসহ ছোট প্রাণী এদের খাবার। হানাস সাপ রাতে খাবারের সন্ধানে বের হলেই মানুষের অজ্ঞাতেই কামড় দিয়ে বসে। সাধারণত উত্ত্যক্ত না করলে এরা কামড়ায় না। কামড়ানোর সময়ও ফনা তুলে না। যে কারণে এর কামড় অনেক সময় বোঝা যায় না। এমনকি কামড়ের দাগও দেখা যায় না। কারণ হানাস মানে কেউটের বিষদাঁত খুব সরু, ফলে এ সাপের কামড় বোঝা যায় না।
কেউটে বা কালকেউটে গোখরা সাপের চেয়ে ৬ থেকে ৮ গুণ বেশি বিষধর সাপ। একবার কামড়ালে ৮ থেকে ১২ মি. গ্রাম বিষ নিঃসরণ করে। এর দুই থেকে তিন মিলি গ্রাম বিষেই প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে।
হানাস সাপের মাথা চ্যাপ্টা, পেছন দিক সরু, শরীর গোলাকৃতি । লেজ ছোট, কিছুটা ভোঁতা আকৃতির। চোখ ছোট ও চোখের তারা গোলাকার অমসৃণ, চকচকে। সাপের দেহের রং ধূসর কালো, তাতে অন্য কোন রঙের দাগ থাকে না।সারা শরীরে সমান্তরাল সাদা ড়োরা।
কালকেউটে সাধারণত গ্রামাঞ্চলে সমতল ভূমিতে ও চাষাবাদের জমির নিচে লুকিয়ে থাকে। জঙ্গলেও থাকে এই সাপ।খোলস বদলানোর পর কালকেউটে রঙ বদলে যায়। তখন ছিলানো মুরগির রঙের মত হয়ে যায়। তবে তার শরীর প্যাঁচানো সাদা ডোরা দাগটা বোঝা যায়।
হানাসে কামডালে বোঝা যায় দেরিতে। যে কারণে চিকিৎসা নিতেও দেরি হয়। আর ততক্ষণে বিষ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই সাপের কামড়ে দংশিত স্থানে সামান্য ব্যথা, চুলকানি, অবশ বোধ করা বা ঝিনঝিন ব্যথা হয়। হাত-পা-গলা অবশ হয়ে যেতে পারে, ঢোক গিলতে পারে না। সাথে বমি হতে পারে। পেট ব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা এবং কাঁপুনি হতে পারে। শেষে মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে অকার্যকর হয়ে পড়বে। নিউরোটক্সিসিটি বা মস্তিষ্ক অসাড় এবং অকার্যকর হয়ে পড়ে। মাংসপেশিও অসাড় বা অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ে। বিষে কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়ে।
এ ছাড়া আরও কিছু শারীরিক জটিলতা হতে পারে,হেমোটক্সিন বা রক্ত দূষণ, মায়োটক্সিন বা মাংসপেশি অকার্যকর এবং নিউরোটক্সিন বা মস্তিষ্ক অকার্যকর। যেগুলোর জন্য রোগীকে আলাদা করে চিকিৎসা বা ওষুধ দিতে হয়।
সাপের রোগীকে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। সাপে কামড়ানোর জায়গাটি ফুলে গেল কি না, রোগীর চোখে দেখতে সমস্যা হচ্ছে কি না, ওপরের পাতা পড়ে গেছে কি না, পেটে ব্যথা হচ্ছে কি না, হাত–পা অসাড় হয়ে আসছে কি না, এটি বিষধর সাপের কামড় কি না – সবকিছু দেখে চিকিৎসককে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
Discussion about this post