চট্টগ্রাম, ২০ ডিসেম্বর, ২০২১ :
শহীদজায়া, নারীনেত্রী ও লেখক বেগম মুশতারী শফী(৮৩) দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর আজ মারা গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক এই মহীয়সী নারীর মৃত্যুতে চট্টগ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বাংলাদেশে গত শতকের ৯০ দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সারাদেশে যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠে চট্টগ্রামে মুশতারি শফী এই আন্দোলনে অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পরও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে রাজপথ সহ সর্বত্র সোচ্চার ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিকে তিনি সহ তার সাথে আন্দোলনকারীরা সর্বস্তরের মানুষের দাবিতে রূপ দিতে ব্যাপক সাংগঠনিক অবদান রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে তার ভাই এহসানুল হক আনসারি ও স্বামী ডাক্তার মোহাম্মদ শফীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা। যে কারণে তাকে শহীদ জায়া হিসেবে সর্বত্র সম্বোধিত হতেন। স্বামীর সাথে তিনি নিজেও একাত্তরের শুরুর সময় থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, সেবা ও অর্থায়নসহ নানা কাজে যুক্ত ছিলেন। মূলত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকের অনেক সাংগঠনিক কাজ তাদের এনায়েত বাজারের শফী লজ থেকে শুরু হয়েছিল।
ডাক্তার শফীর মৃত্যুর পর ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দ সৈনিক হিসেবে কাজ করেন মুশতারী শফী।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে ফেরেন।
মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি তাকে ফেলোশিপ দিয়ে সম্মাননা জানায়।
মুশতারী শফীর মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও শোক প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি তার রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলন আদর্শিক অবস্থানকে এগিয়ে নিতে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
প্রয়াত মুশতারক শফীর স্বজনরা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, মুশতারী শফি দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্ট সহ বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।গত ২ ডিসেম্বর ঢাকার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তির পর তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় বাসায় আনার পর আবার অবস্থার অবনতি হলে ১৪ ডিসেম্বর তাকেঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে(সিএমএইচে) ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি বেশ কিছুদিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। আজ বিকালে লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়ার পর সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ ২০ ডিসেম্বর বিকালে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি সাত ছেলে-মেয়ে রেখে গেছেন। আগামীকাল তার লাশ চট্টগ্রামে দাফন করা হবে।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে মুশতারী শফি শুধু যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতেই নয় সকল প্রগতিশীল আন্দোলন ও নারী প্রগতির কার্যক্রমে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। চট্টগ্রামে সকল নাগরিক আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন তিনি। সর্বশেষ উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি ছিলেন তিনি। যুক্ত ছিলেন মহিলা পরিষদের সঙ্গে। চট্টগ্রামে গণ জাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
মুশতারী শফী লেখক ও সম্পাদক হিসাবেও সমাজ প্রগতির আন্দোলনে নিজকে যুক্ত রাখেন। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রামে বান্ধবী সংঘ প্রতিষ্ঠা ও বান্ধবী পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী সহ তার একাধিক গ্রন্থের লেখক তিনি। এছাড়া ‘আমি সুদূরের পিয়াসী’, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ, ‘স্মৃতিতে অমলিন যারা’, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছোটগল্পের সংকলন ‘দুটি নারী ও একটি মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ ও ‘একুশের গল্প’সহ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ তার।তিনি বেগম রোকেয়া পদক ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এই মহীয়সী নারী ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন।