# ডা. মাহফুজুর রহমান
বাংলাদেশ নদী বিধৌত দেশ। বৃষ্টি হলে বন্যা হবে, ভারতে বেশি বৃষ্টি হলে ভারত সংলগ্ন এলাকা প্রথম ডুববে এর পর বাংলাদেশ প্রায় পুরোটা। স্রোতের তোড়ে মানুষ মারা যাবে। ফসল নষ্ট হবে। গ্রাম ও শহরের বাসা বাড়িতে পানি উঠবে। পাহাড় ভেঙ্গে পাহাড়ের নীচে থাকা ঘরবাড়ির উপর পড়বে। সেখানেও মানুষ মারা যাবে। বৃষ্টি বেশি হলে পানিউন্নয়ন বোর্ডের বাধ ভাঙ্গবে, হাজার হাজার একর জমির ফসল তলিয়ে যাবে। এইসব তথ্য সবারই জানা। সবচাইতে বেশি জানা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের। শুধু একটা কথা কারো জানা নেই- এই সমস্যা থেকে জনগণ মুক্তি পাবে কবে? সরকারও সম্ভবত জানে না। সরকার এবং জনগণের এই যে না জানা এটা আমাদের শাসন ব্যবস্থার ত্রুটি। জনগণ এবং প্রশাসনের মাঝে যোগাযোগহীনতার কারণেই এই অজ্ঞতা।
সিলেটের যেসব এলাকায় বন্যা হয়েছে বা চট্টগ্রাম শহরের যেসব এলাকা বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় সেইসব এলাকার জনগণের কাছে প্রশাসন যদি জানতে চাইতো পানি কোন দিক থেকে তাদের এলাকায় ঢুকেছে তাহলে এলাকার জনগণই তাদের সমস্যার সর্বোচ্চ সমাধান দিতে পারতো। বাধের কাছে থাকা জনগণের কাছে গেলে তারা বলে দিতে পারতো বাধের দুর্বলতা কোথায় এবং কেন এই দুর্বলতা। প্রশাসনও জানতে পারতো কিভাবে কবে সমস্যার সমাধান হবে। অল্প বৃষ্টিতেই চট্টগ্রাম শহরের অনেক অঞ্চলে পানি উঠে ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়। প্রশাসন যদি এলাকার জনগণের কাছে গিয়ে জানতে চাইতো তবে তারা সঠিক পথ নির্দেশ করতে পারতো। ভুক্তভোগীরা ছাড়া কে পারে তাদের নিজেদের সমস্যার সমাধান নির্দেশ করতে?
জাহাজে মালমাল পাঠাবার আগে বা জাহাজ থেকে মালামাল নামানোর পরে যেখানে মালমালগুলো রাখা হতো সীতাকুন্ডের সেই স্থানে ভয়াবহ অগ্নি বিষ্ফোরণ ঘটে অর্ধশত লোক মারা গেছেন। সেই খোলা গুদামের শ্রমিকরাও জানতেন না যে সেখানে রাসায়নিক দ্রব্য আছে। হুকুম বরদারের মতো বিপদজনক স্থানকে নিরাপদ জেনে কাজ করেছে। আগুন নেভানোর জন্য দমকলবাহিনী যাওয়ার পর তারা সঠিক তথ্য অগ্নিসেনাদের দিতে পারেনি। তাই এই ভয়াবহ বিপর্যয়। যে রাসায়নিক দ্রব্য ছাড়া আমরা অচল হয়ে পড়ব, সেই রাসায়নিক দ্রব্যকে বন্দর, আমদানিকারক, জাহাজ কর্তৃপক্ষ ভয় পেতে শুরু করেছে। এর আগে ঢাকাতে রাসায়নিক দ্রব্যের বিষ্ফোরণ ঘটেছিল। সবাই শুধু আশা প্রকাশ করছে- যেন এই জাতীয় দুর্ঘটনা আর না ঘটে। বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থা বহাল রাখা হলে মানুষের এই আশা কেবল স্বপ্ন হিসেবেই থেকে যাবে। এযাবত কাল তাই হয়ে আসছে। শাসকরা শোক বাণী দেবেন, তদন্ত কমিটি হবে, ঘটনার কারণ বের করা হবে, দোষীদের শাস্তি হতেও পারে নাও পারে। আবারো এই জাতীয় ঘটনা ঘটতে থাকবে।
এই জাতীয় সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য জাতিকে ফিরে যেতে হবে বঙ্গবন্ধু প্রণীত সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে। সেখানে বলা (১) আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে। (২) এই সংবিধান ও অন্য কোন আইন-সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করিবেন, এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লিখিত অনুরূপ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক একাংশের মধ্যে সেইরূপ দায়িত্ব পালন করিবেন এবং অনুরূপ আইনে নিম্নলিখিত বিষয়-সংক্রান্ত দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত হইতে পারিবে।(ক) প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য; (খ) জনশৃঙ্খলা রক্ষা; (গ) জনসাধারণের কার্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা-প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে দেশে ১২টি সিটি কর্পোরেশন, ৬৪টি টি জেলা পরিষদ, ৪৯৫টি উপজেলা পরিষদ, ৩২৯-৩০টি পৌরসভা, ৪৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয়েছে। ১২ টি সিটি কর্পোরেশনে ১২ জন নির্বাচিত মেয়র আছেন, ১২টি সিটি কর্পোরেশনের ৪২৮টি ওয়ার্ডে ৪২৮ জন নির্বাচিত কাউন্সিলর আছেন, আছেন ১৪৩ জন নির্বাচিত মহিলা কাউন্সিলর। ৬৪টি জেলায় জেলা পরিষদে ১ জন করে মোট ৬৪ জন নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আছেন, প্রতি জেলা পরিষদে ১৫ জন করে মোট ৯৬০ জন নির্বাচিত সদস্য আছেন, প্রতিজেলা পরিষদে ৫ জন করে মোট ৩২০ জন নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধি আছেন। ৪৯৫ টি উপজেলা পরিষদ ৪৯৫ জন নির্বাচিত চেয়ারম্যান, ৪৯৫ জন নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও ৪৯৫ জন সাধারণ ভাইস চেয়ারম্যান আছেন। ৩২৮ টি পৌরসভায় ৩২৮ জন নির্বাচিত মেয়র আছেন। একটি পৌরসভায় গড়ে ১২টি ওয়ার্ড ধরলে ৩৯৩৬ টি ওয়ার্ড আছে এবং ৩৯৩৬ জন নির্বাচিত কাউন্সিলর ও একতৃতীয়াংশ হিসেবে ১৩১২ জন নির্বাচিত মহিলা কাউন্সিলর আছেন। এই সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। ৪৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদে সমসংখ্যক নির্বাচিত চেয়ারম্যান আছেন। ইউনিয়ন প্রতি ৯জন করে ধরলে ৪১ হাজার ১৩৯ জন নির্বাচিত মেম্বার আছেন, মহিলা মেম্বার আছেন ১৩ হাজার ৭১৩ জন। সব মিলিয়ে বিভিন্ন স্থরের মোট ৬৮ হাজার ৪১১ জনের বেশি নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন। জাতীয় সংসদ সদস্যদের এই হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে। বলা চলে সারা দেশ স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধির চাদরে ঢাকা।
এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কিছু ব্যতিক্রম বাদে সবাই থাকেন নিজ এলাকায় জনগণের পাশে। আগের বার সুনামগঞ্জে বাধ ভেঙ্গে যাওয়ার পর জনগণ দেখেছে এলাকার উপজেলা চেয়ারম্যান এবং এক মহিলা মেম্বার কিভাবে স্থানীয় লোকজন নিয়ে পানি ঠেকানোর চেষ্টা করেছে। বাধ নির্মানে এলাকার উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ড মেম্বারদের কোন ক্ষমতাই নেই। সব ক্ষমতা পানি উন্নয়ন বোর্ডের। শুধু তাই নয় এলাকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বা এলাকার মুল উন্নয়নে আইনে তাদের কোন দায়িত্ব দেয়া হয়নি। সরকারি দফতরের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকির দায়িত্বে তারা নেই। সংবিধান অনুযায়ী তারা ক্ষমতা প্রাপ্ত নন।
সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন সংবিধানের ৫৯ অনুযায়ী স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতা দেয়া এবং তা সুনির্দিষ্ট করণ করা। প্রশাসনকে তাদের তদারকিতে নেয়া এই সময়ে কষ্টকর হবে। তবে প্রশাসন তাদের সাথে সমম্বয় করে কাজ করতে পারে। সবস্তরের স্থানীয় সরকারে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিদের প্রতিনিধিসহ শ্রম পেশা কর্মের প্রতিনিধি রাখা যায়। পঞ্চদশ সংশোধনী পূর্ব সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে এই ব্যবস্থার কথা বলা ছিল।
মোদ্দা কথা হলো- যার সমস্যা তাকেই সেই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দিয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। বঙ্গবন্ধু সংবিধানে সে নির্দেশনাই দিয়েছিলেন।
সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ব্রিটিশ শাসন শুরুর আগ পর্যন্ত রাজা বাদশা সম্রাট ও তাদের আত্মীয়দের মাঝে ক্ষমতা নিয়ে প্রচুর ষড়যন্ত্র, যুদ্ধ খুনোখুনি হয়েছে। তাদের সবার কিন্তু একটি সাধারণ বা কমন নীতি ছিল। সেটা হলো তারা গ্রামীন সমাজকে কখনো দ্বন্ধ বা যুদ্ধে জড়াননি। বাংলার মানুষই গ্রামীণ এলাকায় নিজেদেও নিজেরা শাসন করেছে। অভাবের মাঝেই তারা বাংলার সংস্কৃতি , ভাষা, সাহিত্য গড়ে তুলেছে। যুদ্ধবিগ্রহের মাঝেও রাজা, বাদশা বা নবাবরা তাদের সহায়তা করেছে। ইংরেজরা এসে এই সংস্কৃতি ধ্বংস করে দেয়। তারা প্রশাসনকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা এখনো চলছি সেই ব্রিটিশ নিয়মে। আমাদের এই নিয়ম থেকে সরে এসে প্রশাসন জনপ্রতিনিধি ও জনগণের মাঝে গভীর পারষ্পরিক সহযোগিতা সৃষ্টির অনুকূল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। তবেই সম্ভব বন্যা নিয়ন্ত্রণ, রাসায়নিক বিষ্ফোরণ , জলাবদ্ধতা নিরসনসহ বিভিন্নমুখী সমস্যার টেকসই সমাধান।
লেখক পরিচিতি: ডাক্তার মাহফুজুর রহমান, চিকিৎসক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক।
Discussion about this post