# রহমান মাসুদ
সংখ্যালঘু বা সংখ্যা গুরু অথবা যে কোন ধর্মীয় নাম ধরে চিহ্নিত গোষ্ঠী বা সমাজ আমার কাছে খুব অমানবিক মনে হয়। এইসব শব্দ ভিষন রকমের সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক। আমি এমন বহু ঘটনা সন্দ্বীপ, বরিশাল, যশোর, সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, কক্সবাজারে কভার করেছি। এর বেশিরভাগই শুরু হয়েছিলো ধর্ম অবমাননার ধুয়ো তুলে। কিন্তু নিজের অনুসন্ধানে কোন হামলার পেছনে ধর্মকে পাইনি। কেবল অর্থনৈতিক লোভ ও রাজনৈতিক লালসাই খুঁজে পেয়েছি।
আমার ছোটবেলাটা মধুমতি ও গড়াই কেন্দ্রিক। তবে গড়াইয়ের জল ভাটিতে যখন মধুমতি হলো, তার সঙ্গে স্মৃতি আর বর্তমানের বন্ধনটা বেশি প্রগাঢ়। এই অঞ্চল আমার পূর্ব পুরুষের ভিটা। অন্যদিকে উজানের গড়াই বা তার চারপাশ আমার শৈশবকে মজবুত করেছিল।
মধুমতি নদী গোপালগঞ্জ ও নড়াইল জেলাকে আলাদা করেছে। এপারে আমার গ্রাম। ওপারের গ্রাম ডিক্রিরচর। পাশেই রাধানগর, কুমারডাঙ্গা, দৌলতপুর, ইতনা। ইতনা অবিভক্ত ভারতের সবচেয়ে শিক্ষিত ও আধুনিক গ্রাম ছিলো। রাধা নগর এক সময়ের নাম ছিলো মোকিমপুর। কোলকাতার রানি রাসমনির কাচারি ঘর। এক সময় এখানে একটি থানা ছিলো। এ অঞ্চলের গ্রামগুলোর নামই বলে এলাকাটি হিন্দু বসতিপূর্ণ ছিলো।
আমার গ্রাম মাটলা। আমাদের সব সম্পত্তির পুরোনো দলিল পর্চায় হিন্দু ভূস্বামীদের উপস্থিতি। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যখন এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন, তখন গরু কোরবানি নিয়ে হিন্দু ভূস্বামীদের সঙ্গে ফ্যাসাদ হয়। পরে বৃটিশরা আমাদের জন্য মধুমতির তীরের বিস্তীর্ণ মাঠ বরাদ্দ করেন। বৃটিশদের ‘মাঠ লে’ ঘোষণা থেকেই মাঠলা।
আমাদের পাশের গ্রাম দূর্গাপুর, খালিয়া, পাইকেরডাঙ্গা, ডুবসি ছিলো হিন্দুগ্রাম। এখন নেই বললেই চলে। ১৯৮৮ সালে যখন আমি ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ি, তখন আমার ক্লাসে সহপাঠী ছিলো প্রায় দুশ জন। সেভেনে এসে দাঁড়ালো ৮০। এক বছরে ১২০ সহপাঠী হারিয়ে ছিলাম। যার সবাই হিন্দু। তিনটা গ্রাম এক বছরে হিন্দু প্রধান থেকে হিন্দু শূন্য হলো। এখন যেমন হামলার চিত্র দেখি, তখন তা ছিলো না। বা বুঝের বোধ আমাকে বাধেনি। তবে আমার বুকে এখনো বন্ধু হারানোর শাখঁ দুঃখের গান গায়। বিষ্ণু, বিশ্বজিৎ, স্মৃতি কনা, পিপাসা, মীরাবাই…
সেই থেকে আমি দুঃখী হতে শুরু করি। আমার চারপাশের স্মৃতি আমাকে পোঁড়াতে থাকে। আমার নানাবাড়িতে চুল কাটতেন জগদীশ চন্দ্র শীল। সপ্তাহে একদিন এসে নানাকে সেভ করে দিতেন। আমি নানা বাড়ি গেলে তিনি চুল কেটে দিতেন। সেই শৈশবেই একদিন শুনলাম তারা ইন্ডিয়া চলে গেছেন। দূর্গাপুরের হাঁটে কেরোসিন, লবন বিক্রি করতে আসতেন নারান সাহা। একদিন শুনি তারাও চলে গেছেন। একদিন চলে যায় বাবু ময়রাও।
এতো কথার শুরুটা একটা কারণেই লেখা। নড়াইলের লোহাগড়ার দিঘলিয়ায় যে সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটেছে, সেই ঘটনাস্থল আমার গ্রাম থেকে মাইল পাঁচেক সোজা পশ্চিমে। মধুমতির ওপার। নবগঙ্গা নদীর পাড়ে। পাশাপাশি দুটো গ্রাম। কোলা ও দিঘলিয়া। আমরা একসঙ্গে বলি কোলা-দিঘলিয়া। খুব শান্ত, ছায়াঘেরা জনপদ। ভিষন স্মৃতিময় জায়গা।
আমার স্মৃতিঘেরা জনপদ বড়দিয়া। এক সময়ের বিখ্যাত নৌ বন্দর ও বাণিজ্য কেন্দ্র। আমার বড় খালার বাড়ি। এক সময় বছরের একটি সময় খালাবাড়ি গিযে খালাতো ভাইদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী টোনা, পাটনা, চোরখালি, মহাজন, মাইগ্রাম, লাহুড়িয়া, লুটিয়া, দিঘলিয়া, পাঁচুড়িয়া, লোহাগড়া ঘুরে বেড়িয়েছি। বড়দিয়ার লক্ষীপূজোর আড়ং, লোহাগড়ার রথ আমাদের আনন্দের ভাসান ছিলো। পাইকেরডাঙ্গা, ঘেনাসুর বা খালিয়ার আড়ং আমাদেরই ছিলো। আমরা একসঙ্গেই গাস্সি পালন করতাম। হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ, সাম্প্রদায়িক হামলা আমার ছেলেবেলা বা আমার জনপদের সঙ্গে যায়না।
দিঘলিয়ায় যে হামলা হয়েছে এর পেছনে ধর্ম অবমাননার কারন কতোটুকু আমি জানিনা। যদি তা কিঞ্চিৎ থেকেও থাকে তার পেছনে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য ও আর্থিক লালসাই হয়তো বড় কারণ বলে মনে করি। ইদানিং সেটাই সবখানে দেখা যাচ্ছে। আমি দেশে থাকলে হয়তো নিজ উদ্যোগেই কারন অনুসন্ধান করতাম।
তবে সে যাই হোক, আমার কলিজা দাহ্য হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক এই হামলা আমাকে পোড়াচ্ছে। আপনি চুপ আছেন, কাল আপনার ঘরও তারা পোড়াবে…। সূত্র:https://www.facebook.com/1033327057/posts/pfbid0wjW3mfeQiK5YVcEkHP7EGFLhP8tVR6Q4nVx2DY7safZKG9HM6NVz2HTfiuRQXHN3l/?app=fbl
লেখক পরিচিতি: রহমান মাসুদ- Diplomatic Correspondent, NewsBangla24.com
Discussion about this post