# নাছির উদ্দীন
বিগত ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসের ছাব্বিশ তারিখ বিএনপির সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদোজার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন ডঃ কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম। ১৯৭৮ সালে মরহুম জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করলে সেনা জীবন ও মুক্তিযৃদ্ধের সময়ের বিশ্বস্থ ডঃ অলি আহমদ সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে জিয়ার রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন। অবশ্য জিয়ার দলে যোগদানের সময় অলির চাকরির মেয়াদ তখন আরো আট বছর ছিল। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন চট্টগ্রাম ১৩ বতর্মান ১৪ আসনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অর্থাৎ বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন ব্যারিষ্টার মাহবুব কবির চৌধুরী। তিনি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে চলে গেলে ১৯৮০ সালে উপ-নির্বাচনে বিএনপির সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়ে আসেন ডঃ কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম। তখন থেকে অলি আহমদের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের দক্ষিণে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সাজানো, সুশৃঙ্খল একটি সাংগঠনিক পরিবার। ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পযর্ন্ত অলি আহমদ বিএনপিতে কেন্দ্রীয় কমিটির হয়ে সারা বাংলাদেশে নেতৃত্ব দিলেও তার নির্বাচনী এলাকা চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়ার সমন্বয়ে তিনটি উপজেলার দুটি সংসদীয় আসন একেবারে অলির হাতে গড়া জাতীয়তাবাদী পরিবার; এখানে সাংগঠনিক কার্যক্রম অর্থাৎ ছাত্র, যুবক সহ সব সহযোগি সংগঠন বুদ্ধি-পরামর্শে তৃণমূল পর্যন্ত নেতৃত্বে আসতো বা নেতা সৃষ্টি হতো।
হঠাৎ তিনি নতুন দল প্রতিষ্ঠা করলে সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে কম বেশি টানাটানি হলেও উল্লেখ্য তিন উপজেলায় দলীয় নেতৃত্ব চরম বেকায়দার মুখোমুখি হয়। স্থানীয় বিএনপির নেতাদের মধ্যে প্রত্যেকেই অলির চলে যাওয়াতে নিজেকে এক এক জন ডঃ অলি বলে মনে করে বসে । বিএনপির ব্যানার আছে ঠিকই, কিন্তু গড়ে তুলেছে নিজস্ব বাহিনী- অমুক ভাইয়ের গ্রুপ তমুক ভাইয়ের গ্রুপ।
বতর্মানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আহবায়ক কমিটি এই যে- তিন উপজেলার আহবায়ক কমিটির অনুমতি দিয়েছেন সেখানে দেখা যাচ্ছে ডঃ কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রমের আমলের পুরাতন বিএনপি নেতা অধিকাংশ বাদ পড়েছে; অর্থাৎ নেই বললেই চলে। অথচ এরা কেউ ডঃ কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রমের সাথে এলডিপি করতে ইতিপূর্বে যায়নি, এমনকি সেই তত্ত্বাবধায়ক আমল থেকে তৃণমূলে বিএনপির রাজনীতি ধরে রেখেছেন, অনেকেই মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। বতর্মানে যাদেরকে দিয়ে উপজেলা আহবায়ক কমিটি করা হয়েছে ওখানে কেউ কেউ বয়স্ক, পুরাতন থাকলেও তত্ত্বাবধায়ক আমলের কঠিন সময়ের তেমন ত্যাগী তারা কেউ নন। বতর্মান সময়ে গ্রুপিং রাজনীতি আরো চরম আকার ধারণ করেছে, এমনকি এসব উপজেলার বিভিন্ন স্থানে চলতি বছরে নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং, অনেক মারামারি -ঘাত সহ অনাকাঙ্ক্ষিত মামলা-মোকাদ্দমা নিয়ে আদালত পযর্ন্ত গড়িয়েছে।
যে কোন গণ সংগঠনের রাজনীতি- জেলা বা কেন্দ্রীয় কমিটির তুলনায় উপজেলা বা তৃণমূল ইউনিয়নের রাজনীতি করা অনেক কঠিন এক কষ্টের বিষয়।
যেমন একটি আদর্শগত ক্যাডার সংগঠন কেন্দ্র থেকে সুপরিকল্পিত অর্থ যোগান, সাংগঠনিক নিয়মের ধারাবাহিকতায় নেতৃত্বের পদ-পদবী পাওয়ার যে শৃংখলা অনুসরণ করতে হয় – তা’ কিন্তু গণ সংগঠনগুলোতে মোটেও ধার ধারেনা।
গণ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে একজন উচ্চ শিক্ষিত লোককে শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা বিবেচনা করে পদপদবী দিলে তার রাজনীতিতে ঠিকে থাকতে তেমন সমস্যা হয় না। উপজেলা বা ইউনিয়ন রাজনীতিতে গণ সংগঠনগুলো হঠাৎ যাকে ইচ্ছে তাকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দিতে পারেন না। তিনি দীর্ঘদিন এই রাজনীতির সাথে সংযুক্ত বা অতীতে এই রাজনৈতিক দলের আদর্শের বিশ্বাসী লোক ছিলেন কিনা, অত্র এলাকার সাধারণ কর্মীগণ চুল ছেঁড়া বিশ্লেষণ করবেন। তৃণমূলে উচ্চ শিক্ষিত কেউ হঠাৎ নেতৃত্ব দিতে এলে তার ছাত্র জীবনে মূল দলের সহযোগী ছাত্র সংগঠনে সে জড়িত বা নেতৃত্ব দিয়েছিল কিনা তাও বিবেচনা করবেন এলাকার কর্মী গণ। টাকাওয়ালা কেউ পদ-পদবি নিয়ে নেতৃত্বের হাল ধরলে, টাকার বিনিময়ে তৃণমূলের পুরাতন কিছু কর্মীকে নিজের আয়ত্তে আনতে পারলেও, ওদের টাকা যত দিন আছে তত দিন, পরবর্তীতে আস্তে আস্তে সরে যাবে অথবা যতদিন পযর্ন্ত দল ক্ষমতায় আসেনি ততদিন পযর্ন্ত টাকা খরচ করে ঐ নেতাকে কর্মী ধরে রেখে ঠিকে থাকতে হবে। গণ সংগঠনে তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে ওঠে না এসে হঠাৎ টাকা অথবা শিক্ষার যোগ্যতা নিয়ে উপজেলা অথবা ইউনিয়ন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ পদবি পেয়ে নেতৃত্ব দিলে সেই নেতৃত্ব এলাকায় স্থায়ীভাবে ঠিকে থাকা অনেক কঠিন।
দ্বিতীয় বিষয়- গণ সংগঠনের উপজেলা বা ইউনিয়ন কমিটির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি নিয়ে রাজনীতি করতে টাকা এবং শিক্ষার চেয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তিনি ওই এলাকার সাধারণ মানুষের নিকট ব্যক্তিত্ববান মানুষ কিনা, নাকি গুরুত্বহীন, অযোগ্য। অনেক মানুষ আছে বিভিন্ন কারণে বা সুযোগে অনেক অনেক টাকার মালিক হয়েছেন অথচ এলাকার সাধারণ মানুষ পারিবারিক ঐতিহ্য নিয়ে ব্যঙ্গ করে আবার কিছু মানুষ আছেন অঢেল অর্থের মালিক অথচ কৃপণ; অনেক মানুষ আছেন উচ্চ শিক্ষিত কিন্তু সাধারণ মানুষের সান্নিধ্য পছন্দ করেন না। এসব মানুষ দিয়ে তৃণমূলের রাজনীতি সফলভাবে এগিয়ে নেয়া গণ সংগঠনের জন্য কঠিন হয়ে যায়।
পরিশেষে বলতে হয়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের উল্লেখ্য তিনটি উপজেলায় ডঃ অলি আহমদ এর সান্নিধ্যে ছাত্র দল, যুবদল, মূল দল অর্থাৎ বিএনপির রাজনীতি করা সব নেতাকে কমিটি থেকে বাদ দিয়ে রাতারাতি নতুন নেতা ও নেতৃত্ব সৃষ্টি করলেও সাধারণ কর্মী সমর্থক তো আর রাতারাতি সৃষ্টি করা যাবে না। বিগত ত্রিশ বছরের সাধারণ কর্মী এবং এলাকায় বিএনপির দলীয় সমর্থকদের নতুন কমিটির নেতাগণ সাথে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে বলেই অত্র এলাকায় মিছিলে শ্লোগানের জোয়ার ওঠে না।
লেখক পরিচিতি: নাছির উদ্দীন, কবি ও প্রাবন্ধিক।
Discussion about this post