চট্টগ্রামের সীতাকু-ে শিল্পমালিকদের কাছে জায়গা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে সাগর উপকূলীয় বন উজাড় করা হচ্ছে। অথচ ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর সমুদ্রের ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলের জনজীবন, সম্পদ, ঘরবাড়ি, স্থাপনা রক্ষা করার জন্য এসব গাছ লাগানো হয়েছিল। এখন ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটকে ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে উপকূলীয় বন ধ্বংস করা হচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
জানা যায়, বিগত ২০/২৫ বছর আগে এসব গাছ উপকূলবাসীকে সাগরের জোয়ারভাটা থেকে রক্ষায় সরকারিভাবে লাগিয়েছিল বন বিভাগ। উপকূলের জায়গা দখল করতে স্থানীয় ভূমিদস্যুদের ব্যবহার করছে শিল্পমালিকরা। আর কাটা হচ্ছে উপকূলীয় বনায়নের গাছ। যে কারণে সীতাকু- উপজেলার বাড়বকু- ইউনিয়ন দক্ষিণ নড়ালিয়া ও কৃষ্ণপুর মৌজার সাগর উপকূলীয় এলাকায় দুই শতাধিক আকাশমনি গাছ গত কয়েকদিন ধরে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা শ্রমিক দিয়ে কেটে ফেলছে। মঙ্গলবার সকালে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় ইসমাইল মেম্বারের নেতৃত্বে এলাকাবাসী জব্দ করে কাটা গাছের টুকরো ভর্তি একটি পিকআপ। পরবর্তীতে স্থানীয় মেম্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবহিত করলেও উনি ঘটনাস্থলে বন কর্মকর্তা কামাল উদ্দিনকে পাঠান এবং জব্দকৃত ওই গাছগুলো সীতাকু- রেঞ্জ অফিসে নিয়ে আসেন। গাছ কাটার বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর জোরালো ভূমিকা থাকলেও বন কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এর আগে গত ৩ সেপ্টেম্বর উপজেলার ভাটেরখীল সাগর উপকূলীয় এলাকায় ১০ একর বনভূমির বিভিন্ন প্রজাতির হাজারো গাছ কাটার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। সংবাদ প্রকাশের পর মাসিক মিটিংয়ে তোলপাড় শুরু হলেও ঘটনার রেশ না কাটতে ফের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বন কর্মকর্তাদের যোগসাজসে গাছ কাটা চলছে।
সীতাকু-ের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন বলেন, গত কয়েকদিন থেকে ইউনিয়নের দক্ষিণ নড়ালিয়া ও কৃষ্ণপুর মৌজার সাগর উপকূলীয় এলাকায় শতাধিক বড় বড় আকাশ মনি গাছ কেটে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছিলো ভূমিদস্যু দলের সদস্যরা। বন কর্মকর্তাদের বারবার ফোন করলেও তারা গাছগুলো রক্ষা করতে আসেনি। মঙ্গলবার সকালে আমি বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করার পর বন বিভাগের কর্তারা ঘটনাস্থলে আসেন এবং স্থানীয়দের দ্বারা জব্দ গাছের টুকরাগুলো রেঞ্জ অফিসে নিয়ে যান।
১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্ককরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এ উপকূলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিলো। পরবর্তীতে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে উপকূলীয় জানমাল ও সম্পদ রক্ষা করতে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনির আওতায় এই গাছগুলো সরকারিভাবে বন বিভাগ রোপণ করেছিল।
জানা যায়, মোহাম্মদ আলীদের সাথে উপকূলের গাছগুলো কাটার জন্য ২ লাখ টাকার চুক্তি করেন নড়ালিয়া বন এলাকার বিট কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুস সালাম। সেই হিসাবে মোহাম্মদ আলীসহ কয়েকজন লোক গত কয়েকদিন থেকে গাছগুলো কাটা শুরু করে। কাটার পরে তা টুকরো টুকরো করে ট্রাকে করে নিয়ে করাতকলগুলোতে বিক্রি করে দেয়। আর বিক্রিকৃত টাকা ভাগ-ভাটোয়ারা করে বন কর্মকর্তাসহ ভূমিদস্যুদের মাঝে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বেড়িবাঁধ এলাকার এক কৃষক বলেন, আমার বয়স বর্তমানে ৪১ বছর। আমার বাবাও কৃষক ছিলেন। এই বেডিবাঁধ এলাকায় চাষাবাদ করতেন। আমি কৃষি কাজ করে সংসার চালায়। এই গাছগুলো ৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের পর আমিও লাগাইছি। গত কয়েকদিন ধরে স্থানীয় মোহাম্মদ আলী, খাইরুল বশর, তসলিম ও নাজিম উদ্দিনসহ ১০/১২ জন লোক গাছগুলো কাটছে। বন বিভাগও সব সময় এখানে আসছে। কিন্তু গাছ কাটার বিষয়ে তাদের কোন কিছুই বলছে না। আজ স্থানীয়রা একটি গাছের গাড়ি ধরার পর আপনারা এলেন। এখন যদি উপকূলের বেড়িবাঁধের এ সকল গাছগুলো রক্ষা পায়। গাছ কাটার পর পরিত্যক্ত উপকূলের জায়গাগুলো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছে উঁচু দামে দখলস্বত্ব হস্তান্তর করবে ভূমিদস্যুরা। বন কর্মকর্তাদের যোগসাজসে বনের লাগানো গাছগুলো মূলত কাটছে- এটাই আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে বলে তিনি দাবি করেন।
এ বিষয়ে সীতাকু- রেঞ্জ কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, কারা গাছ কেটেছে তা তদন্ত করা হচ্ছে। এক পিকআপ গাছ স্থানীয়রা জব্দ করে আমাদের খবর দিয়েছে। সেই সূত্রে আমরা ঘটনাস্থলে এসে এক পিকআপ গাছ জব্দ করি। তবে কয়টি গাছ কাটা হয়েছে তা এখনো নির্ধারণ করতে পারিনি। যারাই গাছ কাটুক তাদের শনাক্ত করে গাছ কাটার অভিযোগে মামলা করবো।
অপরদিকে এ বিষয়ে নড়ালিয়া ফরেস্টের বিট কর্মকর্তা আবদুস সালাম বলেন, আমরা বেডিবাঁধের সাথে ঝুলে যাওয়া গাছ কাটার জন্য কয়েকজনকে বলেছি। তবে আকাশ মনি গাছ কাটতে বলিনি। আমরা ঘটনাস্থলে এসেছি, কারা কাটছে- তদন্ত সাপেক্ষে এক এক করে সকলের নাম বের কবরো।
তবে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে- সবাই মিলে এভাবে উপকূলীয় বন উজাড় করতে থাকলে ভবিষ্যতে এলাকায় বসবাসকারীদের উদবাস্তু হতে হবে। আর উপকূলীয় পরিবেশ বিপন্ন হয়ে উঠবে।
Discussion about this post