চট্টগ্রাম, ৯ আগস্ট, ২০২৩:
চট্টগ্রামে ভয়াবহ বন্যায় সাতকানিয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। আজ বুধবার বন্যায় ভেসে যাওয়া জান্নাতুল ফেরদৌস(৪) নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ১৯৭৭ সালের পর এমন বন্যা আর দেখেনি সাতকানিয়ার মানুষ। সাতকানিয়ার অনেক এলাকার মানুষ এখনো পানিবন্দি হয়ে আছে। বিপর্য স্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন।
আজ দুপুর থেকে পানি নেমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম- কক্সবাজার মহাসড়কে দুরপাল্লার যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। কেরানীহাট-গুনাগুরি সড়কেও গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে। তবে কেরানীহাট-বান্দরবান সড়কে পানি থেকে যাওয়ায় সারা দেশের সাথে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
পাঁচ দিনের অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে এই ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হলেও নবনির্মিত রেল লাইনের কারণে পর্যাপ্ত পানি অপসারিত হতে না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠে বলে সাতকানিয়ার মানুষের অভিযোগ।
সাতকানিয়া পৌরসভার বাসিন্দা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ফয়েজ আহমদ লিটন বলেন, রেললাইন নির্মাণের সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্রিজ ও কালভার্ট না রাখায় এ ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭৭ বন্যাকে এ বারের বন্যা ছাপিয়ে গেছে। অন্তত ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকার লোকজন চরম দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়। তাই সাতকানিয়াকে বন্যা দুর্গত এলাকা ঘোষণার জন্য সরকারের নিকট দাবি জানাচ্ছি।
সাতকানিয়া পৌরসভার মেয়র মো. জোবায়ের বলেন, পৌরসভা এলাকার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তা আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে।
পৌরসভা ও উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পানির নিচে নিমজ্জিত থাকায় বিভিন্ন এলাকা এখনো পানিবন্দি। অনেকে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ঘরবাড়িতে ফিরতে পারেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অবিরাম টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যাযর ভয়াবহতায় এখনও অনেক লোকজন মানবেতর কালযাপন করছেন।
আবুল হাশেম নামে ঢেমশার এক রিকশা চালক বলেন,”আমি ব্যাটারি চালিত রিকশা চালাই। ঘরে পানি ঢুকায় মঙ্গলবার সকালে আমরা চার ভাই পরিবার নিয়ে সিটি সেন্টারে আশ্রয় নিই। পানিতে সব ডুবে গেছে। শুধু রান্নার হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে এসেছি। বলতে গেলে এক কাপড়ে এসেছি। ১৯৭৭ সালে একবার বন্যা হয়েছিল। কিন্তু একদিনের মধ্যেই পানি নেমে যাওয়ায় তেমন ক্ষতি হয়নি। এবারের বন্যায় আমাদের সব চলে গেছে। এখন পর্যন্ত কেউ সহায়তায় জন্য এগিয়ে আসেনি। জানিনা কবে ঘরে ফিরতে পারব। টাকা-পয়সা কিছুই নাই। কী করব বুঝতে পারছি না । হতাশা মাখা মুখে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় এবারের বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ঢেমশা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড মাইজপাড়ার বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী আবুল হাসেম।
কথা হয় সিটি সেন্টারের সামনে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকা সাতকানিয়ায় এবারের বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ঢেমশা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও কেরানীহাট নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শহর মুল্লক রাশেদের সাথে। তিনি বলেন, সোমবার রাত প্রায় ৮টার দিকে ঘরে পানি ঢুকে। পানি থেকে বাঁচতে ফ্রিজ, আলমারি ও ঘরের আসবাবপত্রগুলো নিচে ইট দিয়ে উপর করে রাখি। মনে করেছিলাম অতীতের মত একদিন পর পানি নেমে যাবে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পানি বৃদ্ধি পেয়ে সব জিনিসপত্র পানিতে ভেসে উঠে। নিরুপায় হয়ে সেমিপাকা টিনসেটের ঘরে তালা দিয়ে পরিবার নিয়ে বাড়ির পার্শ্ববর্তী একটি দোতলা ঘরে আশ্রয় নিই। এতে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, বন্যার পানিতে ঘর তলিয়ে যাওয়ায় উপজেলার কেরানীহাট সিটি সেন্টার মার্কেটে ঢেমশা, কেঁওচিয়া, ছদাহা ও নলুয়া ইউনিয়নের প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় ওই এলাকার লোকজন কেউ প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড়, রান্না করার হাঁড়ি-পাতিল এবং অনেকেই এক কাপড়েই প্রাণে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছেন সিটি সেন্টারে। অনেকেই নিয়ে এসেছেন গৃহপালিত গরু, ছাগল, হাঁস ও মুরগি। সেখানে দেখা যায়, খোলা ফ্লোরে মাদুর, চাটাই, পাটি ও কাপড়-চোপড় বিছিয়ে শুয়ে আছেন পুরুষ, মহিলা ও ছোট ছেলে মেয়েরা। মহিলাদের মধ্যে অনেকই করছেন রান্নার কাজ। সহায়তা করছেন স্বামী-সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।
একইভাবে কেরানীহাটের পশ্চিম পাশে ইসলাম মেম্বারের ভাড়া বাসায় থাকেন গোপালগঞ্জ জেলার ১৩ ব্যবসায়ী। তারা মাদুর ও মশারির ব্যবসা করেন। সোমবার সকালে বাসায় পানি ঢুকলে সিটি সেন্টারের ফ্লোরে আশ্রয় নেন তারা।
সেখানে কথা হয় ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম, মো.নয়ন ও মো.হৃদয়সহ অন্য ব্যবসায়ীদের সাথে। তারা বলেন, বিক্রির জন্য রাখা সব মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। এতে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মালামাল ছিল। একইভাবে কেঁওচিয়া এলাকার আবদুর রহিম, নলুয়ার জাহাঙ্গীর আলম ও ছদাহার আবদুল করিমও একই দুর্ভোগের কথা বর্ণনা করেন।
এদিকে নলকূপ ও পানির মোটর ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের দোকান বন্ধ থাকায় বন্যা কবলিত লোকজন এখনো সংকটে রয়েছে। মৎস্য খামার ও কৃষি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণির লোকজনের কাজ না থাকায় চরম অর্থকষ্ট রয়েছে তাঁরা।
চরতি ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, কাঞ্চনা-চরতি-বাঁশখালী সংযোগ সড়কসহ এ ইউনিয়নে পানির নিচে তলিয়ে ঘর-বাড়ি, মৎস্য খামার ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানিবন্দি পুরো ইউনিয়নের প্রায় লোকজন।
তবে নতুন রেললাইনই ভয়াবহ বন্যার অন্যতম কারণ- এমন অভিযোগ অস্বীকার করে দোহাজারী- কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ কাজের কনসালটেন্ট প্রকৌশলী মো.মঈনুদ্দিন বলেন, বন্যার বিষয়টি মাথায় রেখে রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে সাতকানিয়া পৌরসভার গোয়াজরপাড়া এলাকায় ভুলে কালভার্ট দেওয়া হয়নি। এখানে রেলপথের কারণে সমস্যার সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ নাই।
বন্যাকবলিত চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় নৌকা ডুবে চারজন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় জান্নাতুল ফেরদৌসের লাশ উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা। শিশুটির নাম জান্নাতুল ফেরদৌস (৪)। মেয়েটি দক্ষিণ চরতি গ্রামের মোহাম্মদ সেলিমের মেয়ে বলে নিশ্চিত করেছেন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ আলী। মোহাম্মদ আলী বলেন, আজ বুধবার বিকাল ৫ টায় বিলের পানিতে একটি গাছের সাথে শিশুটির লাশ দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা আমাকে খবর দেয়।এরপর আমি শিশুটির লাশ উদ্ধার করি। চরতি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রুহুল্লাহ জানান, দক্ষিণ চরতি গ্রাম থেকে পাশবর্তী সুইপুরা গ্রামে যাওয়ার সময় মঙ্গলবার বিকেলে নৌকা ডুবে ৪ জন নিখোঁজ হয়। নৌকায় তিন শিশুসহ ছয় যাত্রী ছিলেন। নিখোঁজ থাকা অন্যরা হলেন- সানজিদা আক্তার আদিরা (৪), মো. শহিদুল ইসলাম (৩) ও তাদের নানা আবদুর রহিম। নিখোঁজ শিশু সানজিদার বাবা আরিফুল ইসলাম জানান, শিশুটি দক্ষিণ চরতী তার নানার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো। বিকেলে আরিফুল সন্তান নিয়ে নৌকায় চড়ে তার নিজ বাড়ি কাঞ্চনা এলাকায় ফিরে যাবার সময় স্রোতের টানে নৌকাটি ডুবে যায়।
Discussion about this post