চট্টগ্রাম, ৫ অক্টোবর, ২০২১: পড়তে পড়তে শরীর-মন উত্তেজনায় তড়বড় হয়ে পড়া থ্রিলার ‘দস্যু বনহুর’। যার লেখক রোমেনা আফাজ। আসলে সেই সময়ে আমাদের কারোই ভাবনায় ছিল না এই রোমেনা আফাজ কে? কারণ বাংলাদেশের একজন নারী লেখক তাও আবার তিনি থ্রিলার লিখেন। দস্যু বনহুর এমনই শিহরণ তৈরি করত যেখানে লেখক কে তাকে খোঁজার বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে পাঠকের কাছে। এটা একজন লেখকের এক সার্থকতা কারণ যিনি লিখেন তিনি ‘ঈশ্বর’। ইশ্বরকে কোথায় খুঁজবে মানুষ। এমনই ‘ঐশ্বরিক সৃষ্টির স্রষ্টা’ রোমেনা আফাজ যার থ্রিলার ছিল অতুলনীয়। সচেতন পাঠক না হলে, প্রয়োজন না হলে রোমেনা আফাজের সেই অর্থে খোঁজ নেননি কেউ।
রোমেনা আফাজ ১৯২৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর বগুড়া জেলার শেরপুরে জন্ম গ্রহণ করেন। পুলিশ পরিদর্শক বাবা কাজেম উদ্দীন আহম্মদ তার পিতা । মায়ের নাম আছিয়া খাতুন। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ৯ বছর বয়সে প্রথম লেখালেখির শুরু। এই সময়ে ‘বাংলার চাষী’ নামক ছড়া প্রকাশ হয় কলকাতার মোহাম্মদী পত্রিকায়। ওই সময় তার বাবা কলকাতার একটি থানার পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১০-১১ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে চলে আসেন শেরপুরে। ১৯৬৫ সালে প্রথম প্রকাশ হয় ‘দস্যু বনহুর’। এই সিরিজ তাকে দারুণ জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তার পরিচিতি গড়ে ওঠে ‘দস্যু বনহুরখ্যাত রোমেনা আফাজ’ নামে। তবে তার প্রথম বই হচ্ছে ‘রক্তে আঁকা ম্যাপ’। বগুড়ার ‘সাহিত্য কুঠির’ নামের একটি প্রকাশনা সংস্থা ১৯৫৯ সালে বইটি প্রকাশ করে। সেটি ছিল দস্যুরানি সিরিজের প্রথম বই। ১৩ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় বগুড়া জেলার সদর থানার ফুলকোট গ্রামের চিকিৎসক মো. আফাজ উল্লাহ সরকারের সঙ্গে। ষাটের দশকে তিনি বসবাস শুরু করেন বগুড়া জেলার জলেশ্বরীতলায়। ২০০৩ সালের ১২ জুন (৭৭ বছর) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওই বাড়িতেই বসবাস করতেন। মূলত বিয়ে পরবর্তি জীবনে তার স্বামী মো. আফাজ উল্লাহ তাকে লেখালেখিতে আরো বেশি উৎসাহিত করেন।
রোমেনা আফাজের সিরিজ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কাব্যগ্রন্থসহ বিভিন্ন ধরনের ২৫০টি বই প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে ১৩৮টি দস্যু বনহুর সিরিজ এবং ১২টি দস্যুরানি সিরিজ।
রোমেনা আফাজের ছয়টি বই থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। ১৯৬৬ সালে ‘কাগজের নৌকা’ বইটির প্রথম চলচ্চিত্রায়ণ হয়। সেটি পরিচালনা করেন সুভাষ দত্ত। এরপর ১৯৭০ সালে ‘মোমের আলো’, ১৯৭৪ সালে ‘মায়ার সংসার’, ১৯৭৫ সালে ‘প্রিয়ার কণ্ঠস্বর’ বইটি থেকে ‘মধুমিতা’ এবং ১৯৯৪ সালে ‘মাটির মানুষ’, এই চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক মোস্তফা মেহমুদ। সবশেষ নব্বই দশকে ‘দস্যু বনহুর’ নামে চলচ্চিত্রের নির্মাণ করেন মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা।
অসংখ্য ছোটগল্প, কবিতা, কিশোর উপন্যাস, সামাজিক উপন্যাস, গোয়েন্দা ও রহস্য সিরিজ রচনা করেছেন রোমেনা আফাজ। তার রহস্য সিরিজ ‘দস্যু বনহুর’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই দস্যু বনহুর চরিত্রের জন্যেই মূলত তিনি বিখ্যাত।
১৯৭৬ সালে মেয়ের মৃত্যুর শোকে একবার লেখালেখিতে ভাটা পড়ে। দ্বিতীয়বার তার লেখায় ভাটা পড়ে ১৯৯৪ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর।
রোমেনা আফাজ শুধু একজন প্রতিভাময়ী লেখকই ছিলেন না, ছিলেন একজন সক্রিয় সমাজ সেবিকাও। ৩৭টি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি৷ তারমধ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থা, বগুড়ার সাবেক চেয়ারম্যান; ঠেংগামারা মহিলা সবুজ সংঘ, বগুড়ার আজীবন উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা পৃষ্ঠপোষক; বাংলাদেশ মহিলা জাতীয় ক্রীড়া সংস্থা, বগুড়ার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান; উদীচী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, বগুড়ার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান; বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতি, বগুড়ার সাবেক সদস্য; শিশু একাডেমী, বগুড়ার সাবেক উপদেষ্টা; বাংলাদেশ রাইটার্স ফোরাম, বগুড়ার সাবেক উপদেষ্টা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য৷
সাহিত্য ও শিল্পকলায় অসাধারণ অবদানের জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশের “সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার” হিসাবে পরিচিত স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয় তাকে। রোমেনা আফাজের অবদানকে ধরে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রোমেনা আফাজ স্মৃতি পরিষদ। সাহিত্যে প্রশংসনীয় বিশেষ অবদানের জন্যে বিভিন্ন সংগঠন থেকে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। তারমধ্যে নারী বিকাশ সংস্থা, বগুড়া থেকে বেগম রোকেয়া স্বর্ণপদক -২০০০; বাংলাদেশ রাইটার্স ফোরাম, বগুড়া থেকে ২১শে পদক (সাহিত্য),২০০৩; গণউন্নয়ন গ্রন্থাগার (সি,ডি,এল) নারী ফোরাম থেকে নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত সম্মাননা পদক, ২০০৬ (মরণোত্তর) ইত্যাদি অন্যতম৷ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে সাহিত্যে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন সময়ে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়; তারমধ্যে ঢাকার নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা গুণীজন-১৯৯৯ সংবর্ধনা উল্লেখযোগ্য৷
জীবদ্দশায় ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল রোমেনা আফাজের সবচেয়ে প্রিয়। চারতলা বাড়ির চারতলায় তার পাঠাগার ছিল। রোমেনা আফাজের মৃত্যুর পর ওই পাঠাগারটিকে ‘রোমেনা আফাজ স্মৃতিঘর’ গড়ে তোলা হয়। রোমেনা আফাজের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে বগুড়ায় সরকারি সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
বাড়ির সামনের সড়কের নামকরণ হয়েছে তাঁর নামে।তাঁদের বাড়ি ছিল বগুড়া জেলার জলেশ্বরীতলায়, যা বর্তমানে স্মৃতি জাদুঘর।
অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এই লেখক ২০০৩ সালের ১২ জুন মৃত্যুবরণ করেন।