বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক এই অপবাদ দিতে শুনলাম অনেককে। আসলে কি তাই? আন্দোলনের সময়, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ খৃষ্টান তো একসাথেই আন্দোলন করেছে একসাথেই যুদ্ধ করেছে, একই বাড়িতে থেকেছে, একই ব্যাংকারে থেকে যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধের কথা না হয় বাদই দিলাম। এখনতো একই অফিসে, একই কারখানায় সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাঙ্গালিরা কাজ করছে। কোন গোলমালের খবর ৫০ বছরেও পাওয়া যায়নি এমনকি পাকিস্তান আমলেও নয়। সেই আমলে গোলমাল হয়েছে বাঙালি-বিহারীর মাঝে। কোন সময় শুনেছেন কি যে মুসলমান রোগীরা হিন্দু ডাক্তারের কাছে যায় না? অথবা হিন্দু রোগীরা মুসলমান ডাক্তারকে বর্জন করেছে? পাকিস্তান বা বাংলাদেশের আমলে কখনো কোন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু বনাম মুসলিম কি দ্বন্ধ হয়েছে? এমনকি কোন ঘটনা ঘটেছে যে হিন্দু বা বৌদ্ধ বা খৃষ্টান শিক্ষকের কাছে মুসলিম ছাত্ররা পড়েনি বা মুসলিম শিক্ষকের কাছে অন্য ধর্মের শিক্ষার্থীরা? এরপরও যারা বলেন- এই দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নেই বা ছিল না তাদের কি বলবেন তা আপনারাই ঠিক করুন। আমি এদের জ্ঞানপাপী বলবো । এরা জেনেশুনেই বাঙালি জাতির উপর কলঙ্ক লেপন করতে চায়। এটা সত্যের একটি দিক।
আরেকটি সত্য হলো পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় আমলেই সাম্প্রদায়িক নির্যাতন চলেছে এবং এখনো চলছে। পাকিন্তান আমল ও বাংলাদেশ আমলে এক শ্রেণির বদমায়েশ ভূমি দস্যু হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি জোর করে দখল করেছে কখনো পরিত্যক্ত সম্পত্তির নামে, কখনো শত্রু সম্পত্তির নামে। পাকিস্তান সরকার এই দস্যুদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি কারণ দস্যুদের সবাই ছিলেন সরকারি দলের লোক। বাংলাদেশ আমলে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ৭২ সাল থেকে আজ অবধি পরিত্যক্ত ও শত্রু সম্পত্তির নামে যে সব জমি ও সম্পত্তি বেদখল হয়েছে তা সবই অতীত ও বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের কিছু লুটেরাদের দখলে আছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি দখলের প্রক্রিয়া হিসেবে চলে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন। গুজব ছড়িয়ে এইসব ডাকাতরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে। আরেকটি কারণ রাজনৈতিক। নির্বাচনের আগে ভোটের হিসেব মিলাতে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা ঘটানো হয়। সরকারকে বিপাকে ফেলতেও এই জাতীয় ঘটনার জন্ম দেয়া হয়। আবার খোদ সরকারও দেশের সমস্যাবলী থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফেরাতে এই জাতীয় ঘটনার জন্ম দিতে পারে। কিন্তু কোন ক্রমেই এটা বলা চলে না যে সাধারণ বাঙালিদের মাঝে ধর্মীয় সম্প্রীতি ছিল না এবং নেই।
পাকিস্তানি জান্তা এই দেশে জাতিগত নিপীড়ন চালিয়েছিল। এই কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিপীড়নকারীদের বিচার হয়েছে, সাজা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি ছিল আমাদের অনেকের। সরকার এই দাবি মেনে নিয়েছে। সাম্প্রদায়িক নির্যাতন যেহেতু চোর ডাকাতদের কাজ, সাধারণ জনগণের কাজ নয় তাই সরকারকে এই চোর ডাকাতদের ধরতে জনগণের সাহায্য নিতে হবে। ৭২ সাল থেকে কারা কারা বঙ্গবন্ধু আদেশ নির্দেশ অমান্য করে পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখলে রেখেছে তাদের খুঁজে বের করে সেই সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে এবং তাদের শাস্তির আওতায় নিতে হবে। ট্রাইবুন্যালের কাজে সহায়তার জন্য শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করতে হবে। কারা কারা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের সম্পত্তি বিভিন্ন কৌশলে দখলে নিয়েছে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিতে হবে। হ্যাঁ, যে চোর ডাকাতদের কথা আমি বলেছি তারা সাধারণ চোর ডাকাত নয়। এদের বেশিরভাগেরই রাজনৈতিক পরিচয় আছে। এরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেই আছেন। তাই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন লাগবে।
একবার যদি এসব বড় বড় চোর ডাকাতদের বিচারে এনে শাস্তি দেয়া যায় তবে সম্পত্তি হাতানোর জন্য সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের আবহ সৃষ্টি করতে এরা সাহসী হবে বলে মনে হয় না।
শেখ হাসিনা ইচ্ছা করলে এটা করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস। শেখ হাসিনার অতীত তাই বলে। আর রাজনৈতিক কারণে যে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের আবহ সৃষ্টি করা হয় তা সচেতন মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে হবে। এখানেও বিচার প্রক্রিয়াকে ভূমিকা রাখতে হবে। সাম্প্রদায়িক নির্যাতন যে কারণেই হোক আর যেই করুক তাকে বিচারের আওতায় নিয়ে সর্বোচ্চ সাজা দানের ব্যবস্থা করতে পারলে এই অমানবিক নির্যাতন বন্ধ হবে বলে আমাদের অনেকেরই বিশ্বাস। এটাও মনে রাখতে হবে অনেক কঠিন কঠিন বিচারের কাজ এই সরকার করলেও সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনাবলীর কোন বিচার এখনো হয়নি। তাই বিচারের কাজ শুরু এবং আসামীদের কঠিন সাজা না হওয়া পর্যন্ত জনগণকে সোচ্চার থাকতে হবে। আসুন আমরা এই অমানবিক নির্যাতনের আসামিদের কঠিন সাজা না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে সোচ্চার থাকি।
ডাক্তার মাহফুজুর রহমান: বীর মুক্তিযোদ্ধা, চিকিৎসক,গবেষক, লেখক, সাংবাদিক।
Discussion about this post