চট্টগ্রাম, ২৪ মার্চ, ২০২২:
কাল ভয়াল ২৫ মার্চ। সেই ভয়াল কালো রাত। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানী শাসক প্রকৃত পৈশাচিক মূর্তি ধারণ করে। মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ নামে চট্টগ্রাম সহ সারাদেশে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, বাঙালির স্বাধীনতা ও শৃঙ্খল মুক্তির আকাক্সক্ষা স্তব্ধ করে দিতে। তারপর বাঙালিও থেমে থাকেনি।
ভয়াল ২৫ মার্চ স্মরণে দিনটি ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। তবে দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশের জনগণ।
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, সেই রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হয় আরও তিন হাজার লোককে। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়াতে থাকলো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। চোখের পলকেই লুট আর ধ্বংসযজ্ঞ যেন তাদের নেশায় পরিণত হল। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হল। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।
পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি স্বয়ং পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়- ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।
সরকারি এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, গণহত্যা দিবসে আজ শুক্রবার রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত সারাদেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ কর্মসূচি পালন করা হবে। এ সময় সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি ভবন ও স্থাপনায় কোনও আলোকসজ্জা করা যাবে না। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকে আলোকসজ্জা করা যাবে। কেপিআই বা সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ জরুরি স্থাপনাসমূহ ব¬্যাক আউটের আওতামুক্ত থাকবে।
গণহত্যা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তারা একাত্তরের বীভৎস গণহত্যাকে শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বমানবতার ইতিহাসেও একটি কালো অধ্যায় বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া এই দিনে পরম শ্রদ্ধার সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ২৫ মার্চ কালরাতের নৃশংস হত্যাকা-সহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মম গণহত্যার শিকার সকল শহিদকে স্মরণ করেন তারা।
একই সাথে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন জাতীয় চার নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-সমর্থকসহ দেশের জনগণকে, যাদের অসামান্য অবদান ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। এদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মত। হেলিকপ্টারযোগে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন শেষে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসে।
ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখলে নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিন গানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময়।
হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান।
সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যে কোনও মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে।
জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনে বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন, সরকারি দপ্তর ও রাজনৈতিক দল নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে।
Discussion about this post