চট্টগ্রাম, ১২ এপ্রিল, ২০২২:
পাবর্ত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন নদীতে আজ ফুল ভাসিয়ে আর বাঙালি হিন্দু পরিবারগুলোর কাল ঘরবাড়ি সহ সকল তৈজসপত্র ফুল দিয়ে সাজিয়ে শুরু হচ্ছে সংক্রান্তি ও নতুন বাংলা নতুন বর্ষ বরণ অনুষ্ঠান। বিশেষ করে আজ থেকে পাহাড়ের মারমা, ত্রিপুরা, চাকমারা শুরু করেছে বর্ষবরণের নানা আয়োজন।
করোনার কারণে গত দুই বছর উৎসব পালন করতে না পারলেও এই বছর পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরের আগমনের পূর্বে তাই নতুন বর্ষ বরণে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি।
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পাহাড়িদের ঘরে ঘরে তিন দিনের বৈসাবি উৎস শুরু হয়েছে। প্রথমদিন পালিত হয়েছে ফুলবিজু। চাকমা রীতি ও প্রথা অনুযায়ী ফুলবিজুর দিন ভোরে নদী, হ্রদ বা পাহাড়ি ঝিরি-ঝর্ণা জলে ফুল ভাসিয়ে শুভ সূচনা ঘটে তিন দিনের বৈসাবি উৎসবের।
রাঙামাটিতে সকালে রাজবন বিহার ঘাটে বিজু উদযাপন কমিটি, পুলিশের পলওয়েল পার্ক ঘাটে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন হিলর ভালেদী ও হিলর প্রোডাকশনসহ বিভিন্ন সংগঠন কেন্দ্রিক পাহাড়ি তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীরা কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসিয়েছেন। যেঞানে বিগত বছরের দুঃখ, কষ্ট, গ্লানি দূর করার আকাক্সক্ষা থাকে। আর আহ্বান থাকে নতুন বছরে অনাবিল সুখ, শান্তি, মঙ্গলময় ও সমৃদ্ধির।
কাল বুধবার পালিত হবে মূলবিজু। উৎসবে অংশ নেবে বষৃ বরণে।
চৈত্র সংক্রান্তিতে বর্ষ বিদায় ও বরণ উপলক্ষ্যে তাদের ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক ও প্রাণের উৎসবটি পালন করে তারা। যা চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, রাখাইনরা সাংক্রান এবং অহমিয়া জনগোষ্ঠী বিহু নামে উদযাপন করে থাকে। আর ত্রিপুরাদের বৈসুক, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু শব্দের আদ্যাক্ষর নিয়ে ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন করা হয়। ১২-১৪ এপ্রিল পাহাড়িদের ঘরে ঘরে মূল উৎসব। নানা খাদ্য ও পানীয়ের সাথে থাকবে ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান, খেলাধুলাসহ নানা আয়োজন।
মঙ্গলবার সকালে গর্জনতলীতে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে ফুল ভাসানোর মধ্যে দিয়ে ত্রিপুরাদের বৈসুক উৎসবের উদ্বোধন করেন রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী। এসময় জেলা পরিষদ সদস্য বিপুল ত্রিপুরাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অরেকটি রাজবাড়ী ঘাটে বৈসাবি উৎযাপন কমিটির উদ্যোগে ফুল বিজুর উদ্বোধন করেন রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
কাল বুধবার মূল বিজুর উৎসবে পালন করবে পাহাড়ের জনগোষ্ঠী। ঐতিহ্যবাহী পাঁচন রান্না করা হবে ঘরে ঘরে। আগামী ১৬ এপ্রিল সাংগ্রাই জলোৎসবের মধ্যে দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘটবে।
খাগড়াছড়ি জেলায় ভোরে চেঙ্গী, ফেনী ও মাইনী নদীর পারে ফুল দিয়ে পূজার মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক ও প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। ফুল বিজুকে কেন্দ্র করে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে নদীর পাড়গুলো হাজারো তরুণ-তরুণীর মিলন মেলায় পরিণত হয়।
এছাড়া ফুল দিয়ে ঘরের প্রতিটি দরজার মাঝখানে মালা গেঁথে সাজানো হয়।
বুধবার মূল বিজুতে পহেলা বৈশাখ বা গজ্জাপয্যা পালন করবে। একই সাথে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের হারিবৈসু, বিযুমা, বিচিকাতাল। ফুল বিজু, মূলবিজু ও বিচিকাতাল নামে নিজস্ব বৈশিষ্টতায় এ উৎসবে আনন্দের আমেজ ছড়ায়। মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাইং উৎসবে ঐতিহ্যবাহী জলকেলি বা পানি খেলা ও জেলা প্রশাসনে উদ্যোগে হবে বর্ষবরণের র্যালি।
বান্দরবানে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের পুরাতন বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে শুরু করেছে নানা কর্মসূচি। সকলের মঙ্গল কামনায় সাঙ্গু নদীতে ফুল ভাসিয়ে ফুল বিজু পালন করলো চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যারা। মঙ্গলবার সকালে বান্দরবানের সাঙ্গু নদীর তীরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের তরুণ তরুণীরা পানিতে ফুল ভাসিয়ে শুরু করে ফুল বিজু উৎসবের। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়েরর শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে বান্দরবানে শুরু করে বর্ষবরণের আয়োজন। সেখানে বেশ ধুমধামের সাথে উদযাপন করা হবে মাহা সাংগ্রাইং উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মধ্যে মারমা জনগোষ্ঠী সাংগ্রাইং নামে এ উৎসব পালন করে।
বান্দরবানেই মারমা সম্প্রদায়ের জনসংখ্য বেশি, তাই বান্দরবানে মূলত এই সাংগ্রাইকে ঘিরে কয়েকদিন চলে বর্র্ণিল আয়োজন। নতুন পোশাক পরে, নানা সাজে সেজে উৎসবে মাতে সকলে।
সাংগ্রাইং উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি থেওয়াং (হ্লাএমং) সংবাদ মাধ্যমকে জানান, নানা আয়োজনে ১৩ই এপ্রিল সকালে বান্দরবান রাজার মাঠ থেকে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে শুরু হবে সাংগ্রাই উৎসবের আর শোভাযাত্রা শেষে বয়ঃজ্যেষ্ঠ পূজা। ১৪ই এপ্রিল সকালে মিনি ম্যারাথন দৌঁড়, বিকালে পবিত্র বুদ্ধ মূর্তি ¯œান, রাতব্যাপী পিঠা তৈরি উৎসব, ১৫ই এপ্রিল বিকালে বান্দরবানের উজানীপাড়া সাঙ্গু নদীর চরে মৈত্রী পানি বর্ষণ, ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, তৈলাক্ত বাঁশ আরোহণ ও সবশেষে ১৬ই এপ্রিল সন্ধ্যায় বিহারে বিহারে হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও সমবেত প্রার্থনার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী এই সাংগ্রাই উৎসবের।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার জেরিন আখতার সংবাদ মাধ্যমকে জানান, বান্দরবান একটি শান্তপ্রিয় শহর। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চাইতে এই এলাকার পরিবেশ সবসময় শান্ত থাকে। আমরা নববর্ষকে কেন্দ্র করে পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছি।
শুধু জেলা কেন্দ্রিক নয় এ সব জেলার গুলেঅর প্রত্যেক উপজেলার গ্রামে গ্রামে , ঘরে ঘরে আনন্দেও ডেউ উপচে পড়ছে নতুন বর্ষ বরণ ও পুরনো বর্ষ বিদায়ের।
Discussion about this post