মানুষ সমাজবদ্ধ বলেই সামাজিক জীব। সমাজ বিজ্ঞানীর এ বাণী চিরন্তন। আদি সমাজে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে কিছু ছিল না। তৎকালে মানুষ ছিল যাযাবর প্রকৃতির; জন্তু-প্রাণীর মতো দলবদ্ধ হয়ে খাদ্যের সন্ধানে ছুটে যেতো। প্রাণী শিকার বা বৃক্ষের কাঁচা ফল-মূল খেয়ে জীবন যাপনই তাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল। স্রষ্টার সৃষ্টিকে রূপান্তরিত করা, যেমন রান্না-বান্না, নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু আবিস্কার অথবা উদ্ভিদ সৃজনে খাদ্য উৎপাদনের চিন্তাও তখন মস্তিষ্কে আসেনি। তাই মানুষের মাঝে শ্রেণীভেদ বা শ্রেণীদ্বন্দ্ব সেই সময় ছিল না। এসময়কে আদি যুগ বলা হয়।
অগ্রগামী মানুষ সাধারণ সহজ-সরল মানুষগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অদৃশ্যের ভয়, দৈত্য-দানবের কথা বলে এবং দেব-দেবীর মঙ্গলের কথা, প্রত্যাশার কথা বলে প্রার্থনা চালু করেন। প্রয়োজন নিমিত্তে গোত্র পরিচালনার একটি সিস্টেম চালু করেন। এখানেই দক্ষিণা শব্দটির উৎপত্তি। অর্থাৎ পুরোহিতদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক। যা বতর্মানে শিষ্য বা ছাত্র কর্তৃক উপাধ্যায়কে প্রদত্ত অর্থ। সেসময়ে গোত্র বা সমাজে নিম্ন মানুষ কর্তৃক উচ্চ মানুষকে প্রদত্ত অর্থকে দক্ষিণা বলা হতো।
আরবে সেমিটিক, হিব্রু জাতি-গোত্র থেকে শুরু করে কোরাইশ মুহাম্মদ (সঃ) এর ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত- পরিপূর্ণ দক্ষিণা নিয়মে ধর্মকে তৎকালে অগ্রগামী মানুষগুলো ব্যবহার করতো। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ বছর আগে নবী হযরত ইব্রাহিম ( আঃ) দৈত্য-দানব, দেব -দেবীর বিরোধিতা করে বিপ্লব ঘটান এবং সফল হন। তারপরও যুগে যুগে এ প্রথা ছিল বিধায় নবী হযরত মুসা (আঃ), নবী হযরত দাউদ( আঃ) এবং নবী হযরত ঈসার (আঃ) আগমন ঘটে। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এসে দেখেন দাস প্রথা, পণ্যের মতো নারী বিক্রি ও দেব -দেবীর নামে ঘটি-বাটি পড়া দক্ষিণার বিনিময়ে ধর্মযাজকরা দেয় এবং এরাই সমাজ বা গোত্রের নিয়ন্ত্রণ কর্তা। এসময়ে পরিপূর্ণ শ্রেণী সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। দাস প্রথার বেচাকেনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিম্ন শ্রেণীতে পরিণত হয়েছিল।
হযরত মুহাম্মদ(সঃ) বদর, ওহুদ, খন্দক, খাইবারের যুদ্ধ সহ বিভিন্ন সংগ্রামে ওনার বিশ্বাসে পরিপন্থীদের সাথে মুখোমুখি হন। সর্বশেষ ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে দশ হাজার মুসলমানদের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মক্কা বিজয় করেন এবং কাবা ঘরের ৩৬০টি মূর্তি হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর নির্দেশে হযরত ওমর গুঁড়িয়ে দেন। ৮ জুন, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে অথবা ১১ হিজরির ১২ রবিউল আওয়াল হযরত মুহাম্মদের (সঃ) ওফাত হয়। ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ পবিত্র আল কোরআনের বিধি মোতাবেক একটি আরব গোত্রীয় শাসন থেকে পরিপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস ছিল পাঁচটা: ১.আল্ গানিমাত। যুদ্ধ লব্ধ দ্রব্যসামগ্রীকে গানিমাতের মাল বলা হয়। ২.যাকাত ৩. আল জিযিয়া। ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম প্রজাবৃন্দকে জান ও মাল রক্ষার নিমিত্তে যে কর দিতে হতো তাই আল্ জিযিয়া। ৪.আল্ খারাজ। অমুসলিম প্রজাদের ভূমির খাজনা বা রাজস্বকে খারাজ বলে। সর্ব প্রথম ইহুদি কৃষকদের উপর এ কর ধার্য করা হয়। অর্থাৎ উৎপাদিত দ্রব্যের কিছু অংশ ইহুদিরা নিজে নবী মুহাম্মদ (সঃ) বরাবর পৌঁছে দিতেন। ৫. আল্ পে। আল্ পে অর্থ রাষ্ট্রীয় ভূ সম্পত্তি। কোন স্থান জয় হওয়া মাত্র আবাদি সম্পত্তি সরাসরি রাষ্ট্রীয় ভূসম্পত্তিতে পরিণত হতো।
খুলাফায়ে রাশেদীন- অর্থাৎ চার খলিফার শাসন। তাদের মধ্যে প্রথম হযরত আবু বক্কর( রাঃ)। উনার আমলে চার জন নবী (ভ-) দাবি করেছিলেন। আসোয়াদ আনসী, মুসাইলিমা, সাজাহ (মহিলা), বানু আসাদ গোত্রের গোত্রপতি তোলাইয়া। ওরা প্রত্যেকেই ক্ষমতাধর, ধনবান। মানুষ নবী মুহাম্মদের (সঃ) ধর্মের উপর বিশ্বাসী তাই ওরা প্রভাববিস্তার করে মানুষের বিশ্বাসকে চিনিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। আবু বক্কও (রাঃ)অভিযানে সফল হয়। সময় কাল ৬৩৩-৬৩৪ খ্র্রিস্টাব্দ।
হযরত ওমরের (রাঃ) সময়ে অনেক রাজ্য বিজয়, আইনশৃঙ্খলা বিভাগ সৃষ্টি এবং বিচার বিভাগ সুদৃঢ় এবং মজবুত নিরপেক্ষ হয়। ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে ফিরোজ নামক আততায়ির হাতে উনি প্রাণ হারান। সময় কাল ৬৩৪- ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ।
হযরত ওছমান (রা.) ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় বিত্তশালী পরিবারে জন্ম নেন। ইসলামের জন্য উনার অর্থদান উল্লেখযোগ্য অবদান। কুফা, বসরা এবং মিসর হতে অশান্ত প্রতিনিধি দল এসে উনার গৃহে প্রবেশ করে হত্যা করে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ তখন উনার বয়স ৮০ বছর। ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা। সময় কাল ৬৪৪-৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ।
হযরত আলী(রা.) হযরত মুহাম্মদের (সঃ) সান্নিধ্যে লালিত-পালিত হন। আলী সেই সময়ে মুসলমানদের মধ্যে অন্যতম শিক্ষিত। মুহাম্মদ (সঃ) এর জামাতা অর্থাৎ মা ফাতেমার স্বামী। আবদুর রহমান বিন মালজান নামক একজন খারেজি ৬৬১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি ফজরের নামাজরত অবস্থায় হযরত আলীকে (রাঃ) হত্যা করে। সময় কাল ৬৫৬-৬৬১ খ্রিস্টাব্দ। মক্কা বিজয় ৬৩০ হতে ৬৩১ পর্যন্ত। মোট ত্রিশ বছর একটি গ্রহণযোগ্য ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছিল, এখানেও খুলাফায়ে রাশেদীনের খেলাফতপ্রাপ্ত শেষ তিনজন খলিফাকে মুসলমান কর্তৃক হত্যার শিকার হতে হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
একই সময়ে ভারতবর্ষে গৌড় রাজ্যে রাজা শশাঙ্ক, সময় কাল আনুমানিক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দ এবং পাল সাম্রাজ্য, সময় ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের শুরু; এছাড়াও পরবর্তী সেন, গুপ্ত বংশ ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে শাসন প্রচলিত ছিল তা ধর্মনির্ভর ও উচ্চনিম্ন বর্ণের জাত শ্রেণিভেদ ছিল।
ইউরোপ বা পশ্চিমা দেশেও খ্রিস্টপূর্বের হাজার হাজার বছর আগে থেকে ধর্মনির্ভর, ধর্ম প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাস আছে।
এসব আলোচনা থেকে অবশ্যই নিশ্চিত, উল্লেখ্য সময়ে পৃথিবীর এ ধর্মনির্ভর সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনায় বাজেট ছিল ধর্মীয় দক্ষিণা হিসেবে পাওয়া। এ ধারাবাহিকতায় এখন যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেন (ধর্মনির্ভর রাজনীতি) অথবা ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান উনাদের রাজনীতিকে দক্ষিণপন্থী হিসাবে রাজনীতি বিশ্লেষকগণ বিবেচনা করেন।
একথা কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক, পৃথিবীর জন্ম ইতিহাস থেকে তৎসময় কাল পর্যন্ত যেসব ধর্ম নিয়ে সমাজ /গোত্র বা রাষ্ট্র পরিচালনা হয়েছে তার মধ্যে নবী মুহাম্মদের (সঃ) জীবদ্দশায় ও খুলাফায়ে রাশেদীনের মোট ৩১ বছর শাসনই সর্ব শ্রেষ্ঠ। কারণ এখানে মানুষের মধ্যে শ্রেণীভেদ ছিল না। গণতন্ত্র ছিল। আগেকার শাসনের চেয়ে অনেক গ্রহণযোগ্য, আধুনিক। আদি থেকে ধর্মনির্ভর সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনাকে দক্ষিণা থেকে দক্ষিণপন্থী বলা হয়।
ডানপন্থী: মানুষের ডানহস্ত শক্ত সামর্থ, সৃষ্টির প্রদত্ত দান। সুতরাং ডান বলতে শক্তিশালী পেশিকে বুঝানো হয়েছে। যে সব শাসক পেশি শক্তি দিয়ে সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখে এবং রাষ্ট্রে জনগণের নিজস্ব ভূসম্পদ বলতে কিছুই থাকে না অর্থাৎ জনগণ মাত্রই প্রজা- সেই সময় এসব শাসকরাই ডান হিসেবে পরিচিতি ছিল। আরবে কোরাইশ দলপতি আবু সুফিয়ানের পুত্র মু’য়াবিয়ার খেলাফতের উমাইয়া বংশ সৃষ্টি (৬৬১-৭৪৯ খ্রিঃ) এবং আব্বাসী খিলাফত হতে স্পেন উমাইয়া, মিশর, উত্তর আফ্রিকা- শাসন প্রত্যেকটিকে পর পর ধারাবাহিক ডান শাসক বলা যায়। এছাড়াও পরবর্তী আফগান মোগলগণ ভারতবর্ষে ইসলামের খোলস ব্যবহার করে পরিপূর্ণ ডান শাসন ছয় শত বছর বহাল রাখে। সাম্রাজ্যবাদী শব্দটি মূলত এদের শাসন আমল থেকে উৎপত্তি। সুলতান সোলায়মান সিরিয়ালে সাম্রাজ্য বিজয়ের পরিকল্পনা তো সবাই দেখেছেন। আরব বিশ্বের ডানপন্থী বা সাম্রাজ্যবাদীর চেয়ে ভারতবর্ষের মুঘল সাম্রাজ্যবাদীরা কঠিন ও ভোগ বিলাসী অধিকতর বেশি ছিল। আরবের বাগদাদে খলিফা হারুনর রশিদ নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত করার জন্য বড় মাদ্রাসা তৈরি করেছিলেন। মুঘলরা কোথাও কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেনি। ইমারত, রাজ মহল, রংমহল, তাজমহল তৈরি করেছেন সাধারণ চাষাভুষোর খাজনার টাকা দিয়ে। তাদের চরিত্র বৃটিশ আমলে ভারতবর্ষের জমিদারাও পেয়েছিল। কোন জমিদার তার এলাকার মানুষের সন্তান শিক্ষিত হোক, একটু সুন্দর আধুনিক পোষাকে সজ্জিত জীবন যাপন করুক এটি চাননি। নির্যাতিত হয়ে প্রতিবাদ করলে আরো নির্যাতন। সর্বসাধরণের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যুগোপযোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃটিশ সরকার সৃষ্টি করেছিল। এখানেও প্রজার ছেলে উচ্চ শিক্ষিত হতে জমিদার কর্তৃক স্থানীয়ভাবে কতো যড়যন্ত্র পেরিয়ে যেতে হয়েছে। আমিও সব বাঙালির মতো মীর জাফরের যড়যন্ত্রে নবাব সিরাজ দ্দৌলার পতন ও বেআইনি হত্যা মেনে নিতে পারি না। তবে নবাব সিরাজ দ্দৌলার ধারাবাহিকতায় আরো দুই শত বছর দেওয়ানি শাসন বহাল থাকলে ভারতবর্ষের বাঙালি জাতির শিক্ষা ও জীবন যাত্রার মান কেমন হতো তা কল্পনা করলে ভাবি, আমি এ দিনে অংকের নামতাও মুখস্ত জানতাম কিনা সন্দেহ। উল্লেখ্য আলোচনার ডান বা পেশি বা সাম্রাজ্যবাদী শাসকগণ নিজেদের ভোগবিলাসী জীবনকে অধিক প্রাধান্য দিতেন। আজ আমরা আধুনিক বিশ্বে যাদেরকে সাম্রাজ্যবাদী বা পুঁজিবাদী ডান বলে থাকি তারা বিশ্বের ব্যবসায়ী পুঁজিবাদী ঠিক, কিন্তু কেউ কারো রাষ্ট্র-সমাজ দখলে নিয়ে ঘটি-বাটি সহ ডাকাতি করছে না। সে জমানা এখন নেই। মধ্যযুগের রাজা-বাদশার মতো কি আমেরিকার রাষ্ট্রপতিদেরকে নিজের ও পরিবারের জন্য সম্পত্তির পাহাড় বা রাজমহল বানিয়েছেন কেউ শুনেছেন?
আজকাল বাংলাদেশের বড় বড় ওয়াজের মৌলানারা নিজেদের ডানপন্থী ইসলামিক দল দাবি করে। ওদের যুক্তি ডান অর্থ নাকি আস্তিক আর বাম অর্থ নাস্তিক। হুজুরদের কোন যুক্তির প্রয়োজন নেই। সোজাসুজি বলে দেবেন, ডান মানে পবিত্র আর বাম মানে অপবিত্র। ইসলামের নামে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করলে পবিত্র, আর পৃথিবীতে সব রাজনীতি অপবিত্র অর্থাৎ বাম।
এখন আমার বক্তব্য, আপনি দক্ষিণপন্থী স্বীকার না করেন ঠিক আছে অন্তত বলুন ‘ডান-বাম কোন প্রয়োজন নেই, আমরা নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল।’
পৃথিবীর ইতিহাস অনুযায়ী বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলো ডানপন্থী দাবি করলে তখন উনারা উমাইয়া, আব্বাসী বা সর্বশেষ মুঘল ঘরানায় পড়ে যায়; যেখানে সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করা হয়েছিল। অথচ সাধারণ সমর্থক বা স্থানীয় জনগণের নিকট বায়তুল মাল নামের যে অর্থ আদায় করা হয় তা মূলত আদি বিভিন্ন ধর্মের ‘দক্ষিণা’ আদায়ের সাথে বিষয়বস্তুর পরিপূর্ণ মিল। যেমন- সাধারণ মানুষ সেকালেও ধর্মে দক্ষিণা পরিশোধ করত পুণ্যের জন্য বা স্বর্গপ্রাপ্তির আকাক্সক্ষায়। বতর্মানে ইসলামিক দলগুলোতে সাধারণ গরিব বা সমর্থনকারী লোক বায়তুল মাল দিয়ে প্রথমত নিজের মধ্যে সান্ত¦না পায় ‘আল্লাহর রাস্তায় অর্থ দিয়ে দিলাম অবশ্যই পরকালে আমি নেকি বা ছোয়াব পাইব।’
যে দানে পরকালে বিনিময় পাওয়ার আশা ও বিশ্বাস থাকে তাকে দক্ষিণা বলে এবং যারা এসব অর্থের সহযোগিতা নিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল করে তাদের রাজনীতিকে দক্ষিণপন্থী বলা যুক্তিযুক্ত।
এখানে বলা প্রয়োজন, সুফী সাধকরা ভারতবর্ষে এসে নির্যাতিত নিপীড়িত নিম্ন বর্ণের শূদ্র জাতি, গোষ্ঠিকে ভালোবাসা দিয়ে ইসলামের পথে দীক্ষা দিয়েছিলেন। ইসলামে উঁচু-নিচু জাতভেদ, শ্রেণিভেদ নেই- একথা প্রমাণ করেছিলেন সুফীগণ, নিজেদের আচার-আচরণে। যখন নিম্নবর্ণের বৃহৎ একটি অংশ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তখন ইসলাম গ্রহণকারী ও সুফী সাধকগণ মুসলমান সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখেন। এ সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিল শিহাব উদ্দিন ঘুরীর নিকট- সমরশিক্ষায় প্রশিক্ষিত গজনীর মুহাম্মদ খলজী। ভারতবর্ষে দলবল নিয়ে এসে ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের পতাকা তুললে নিম্ন বর্ণের ধর্মান্তরিত অস্পৃশ্য শূদ্রগণ এ বিজয়কে সমর্থন করে এবং এক কোটি নির্যাতিত, নিপীড়িত প্রকাশ্যভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
এ কথার সত্যতা যাচাই নিয়ে একজন মানবতাবাদী, হিন্দু প-িত স্বামী বিবেকানন্দের উদ্ধৃতি তুলে ধরা প্রয়োজন। ‘ভারতে স্বামী বিবেকানন্দ’ পুস্তকে পৃষ্টা ৩২৭-২৮ তিনি লিখেছেন, ‘এমন কি মুসলমান অধিকারের একচেটিয়া অধিকারাহিত্য রূপ মহা সুফল ফলিয়াছে। আর মুসলমান রাজত্ব যে প্রকৃত পক্ষে সম্পূর্ণ মন্দ ছিল তাহাও নহে। মুসলমানের ভারতাধিকার দরিদ্র পদদলিতদের উদ্ধারের কারণ হইয়াছিল। এজন্য আমাদের পঞ্চমাংশ ভারতবাসী মুসলমান হইয়া গিয়াছিল। কেবল তরবারির বলে ইহা সাধিত হয় নাই। কেবল তরবারি ও বন্দুকের বলে ইহা সাধিত হইয়াছিল, একথা মনে করা নিতান্তই পাগলামি মাত্র।’
সুফীগণ যে মুসলমান সাম্রাজ্য স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং নিজেদের মধ্যে লালন করেছিলেন তা আদৌ তখন ইসলামী সিস্টেমের ধারে কাছেও বাস্তবায়ন হয়নি। এখানে স্বামী বিবেকানন্দের মন্তব্য সঠিক।
বতর্মান সময়ে মাজার ঘিরে সেই সুফী সাধকের নাম ভাঙ্গিয়ে, সাধারণ মানুষের সরলতাকে কাজে লাগিয়ে অনেকে ব্যবসা করেন। সুফী সাধক শব্দটি ওদের কারণে আজ হাস্যকরে রূপ নিয়েছে।
বামপন্থী: বাম হস্ত দুর্বল অর্থাৎ বাম বলতে দুর্বলদের বোঝায়। দুর্বল মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য যারা সাম্রাজ্যবাদী এবং পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন ওদেরকে বামপন্থী বলে।
দক্ষিণপন্থীর ধর্মীয় দেয়াল আর যুগে যুগে ধর্মযুদ্ধ এবং ডানপন্থী বা সাম্রাজ্যবাদীর পেশিশক্তির জোরে রাষ্ট্র দখল, পরবর্তীতে পুঁজির জোরে মানুষকে জিম্মি, ব্যবসা বাণিজ্যে প্রভাববিস্তার করে মহাজনী রাষ্ট্র তৈরিই গরিবকে আরো গরিব এবং অধিকারহারা করে তুলে।
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে মার্কস ও এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ম্যনিফেস্টোতে প্রথম বাক্যটি হচ্ছে, আজ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে যতো সংগ্রাম দেখা গেছে তা সবই শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস।
অবশ্যই আমরা ধরে নিতে পারি উচ্চ বর্ণ, নিম্ন বর্ণ, জাত-পাত, দাস-মনিব এবং বিশ্বাস নিয়ে ধর্মযুদ্ধ সহ যাই বলি, সবই মানুষের মধ্যে যুগে যুগে শ্রেণীভেদ, সংঘাত, যুদ্ধ সৃষ্টির মূল শিকড়ের বিষয়- অর্থ ও ক্ষমতা।
তাই মার্কসের দর্শন বস্তুবাদ। অতীতের সব বিষয় বিবেচনায় এনে মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য উৎপাদন ও অর্থ বন্টনকে প্রাধান্য দিয়ে উনার সৃষ্টি উধং কধঢ়রঃধষ.
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্ব অনুযায়ী উৎপাদন- সম্পর্কিত উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণকারী- সংখ্যালঘু মালিকদের সঙ্গে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের প্রাপ্যতা নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি করে। কাল মার্কস একেই বলেছেন শ্রেণি সংগ্রাম। শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে এক একটি সমাজ ব্যবস্থার উত্থান-পতনই হল সমাজ বিকাশের চালিকাশক্তি। যেমনটা- এভাবেই শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন হয়ে আদি থেকে এ পযন্ত এসে পৌঁছেছে।
কাল মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের জনক। কাল মার্কস মনে করেন বস্তু সত্য। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হলো মার্কসবাদের প্রধান ভিত্তি। এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ দিয়ে কাল মার্কস মানব সমাজের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করেছেন।
কাল মার্কস দেখিয়েছেন, বিশ্বের প্রতি বস্তুর মধ্যে বিরোধের বীজ উপস্থিত অর্থাৎ এক সঙ্গে পরস্পরবিরোধী শক্তি যুক্ত থাকে। একটির নাম হচ্ছে ‘বাদ’ (ঞযবংরং) অপরটি ‘প্রতিবাদ’( অহঃরঃযবংরং)। উভয়ের মধ্যে সংঘাতের ফলে উন্নতর এক স্থরের জন্ম বা সৃষ্টি হয় যাকে বলা হয় সম্বার(ঝুহঃযবংরং)। পুরনো থেকে যখন নতুনদের আবির্ভাব ঘটে- তখন নতুন, পুরাতনের চাইতে গুণগত দিক থেকে উন্নত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে। এভাবে দাস প্রথা থেকে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থার এ খেলা চলেছে নিরন্তর এবং প্রক্রিয়া গতিশীল। মার্কস ও এঙ্গেলস ইতিহাসে বস্তুবাদী ব্যাখ্যার প্রথম প্রবক্তা।
কাল মার্কস দাবি করেন, অস্থিতিশীল সংকটপ্রবণ পুঁজি ব্যবস্থায় ক্রমাগত শ্রেণী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে মজুর, কুলি, শ্রমিক শ্রেণীর মাঝে শ্রেণিভেদ চেতনার জন্ম হবে; যার ফলে উনাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা গড়ে ওঠবে। একদিন এ ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক শ্রেণী পুঁজিবাদী বুর্জোয়া শাসকে ক্ষমতাচ্যুত করে শ্রেণিভেদহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মার্কস, এঙ্গেলসের শ্রেণী সংগ্রাম সফল হয়েছে।
মাও সেতুং চীনা বিপ্লবী মার্কসবাদী তাত্ত্বিক একজন রাজনৈতিক নেতা। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে তার হাত ধরে চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। তিনি মার্কসবাদ-লেলিনবাদে এতোটাই সফল যে-তার তাত্ত্বিক অবদান, সমরকৌশল, কমিউনিজমের নীতি পৃথিবীর দরবারে একক মাওবাদ নামে প্রতিষ্ঠা ও পরিচিতি লাভ করে।
ফিদেল কাস্ত্রো, কিউবা বিপ্লবের প্রধান রাজনৈতিক নেতা। সমাজতন্ত্রী বিপ্লবে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রধানমন্ত্রী এবং ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে মন্ত্রী পরিষদে প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বতর্মান প্রেসিডেন্ট বতর্মান কমিউনিস্ট পাটির প্রধান মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেল। সমাজতন্ত্রী শাসন পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন চরম অবস্থানে এখন। রাস্তায় সেনাবাহিনী নামিয়ে বিরোধীদের দমন করতে হচ্ছে। ৬১ বছরের অধিক সময় ক্ষমতায় আছে কিউবার কমিউনিস্ট সরকার। সাবেক কমিউনিস্ট রাশিয়ার বাইরে দুইটা দেশের কথা উল্লেখ করেছি এ কারণে- শ্রেণী সংগ্রাম বা মার্কসবাদী সমাজতন্ত্র রাশিয়ার স্টাইলে বা সিস্টেমে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে এমন কোন কথা নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। মার্কস-এঙ্গেলস বা পরবর্তী লেলিনের মূল তত্ত্বের আলোকে।
ভারতবর্ষ এবং পরবর্তী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট বা মার্কসবাদ, এঙ্গেলসবাদ অথবা বাম রাজনৈতিক দল: কাল মার্কস বস্তুবাদ তত্ত্ব লেখার সময় উনার মস্তিষ্কে জার্মান-ইউরোপ বা পশ্চিমা দুনিয়ার পরিবেশ-পরিস্থিতি কাজ করেছিল। যদিও শ্রেণি সংগ্রামের বিষয়টি সারা পৃথিবীতে অভিন্ন কিন্তু মানুষের মনের বিশ্বাস, সামাজিক সংস্কৃতি- স্থানভেদে একান্ত ভিন্ন। তাই এমনও হতে পারে, আগেকার ধর্মীয় শাসনের ইতিহাস বিবেচনায় এনে রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ আলাদা করার চিন্তা করেছেন। অথবা অর্থনীতিবিদ হিসেবে ‘ধর্ম’ মার্কসের নিকট অর্থবহ আলোচনায় ছিল না।
সোভিয়েত রাশিয়ায় রুশ বিপ্লব ঘটে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ। মূলত ঐদিন নারী দিবস, তাই নারীরা অধিকার আদায়ের দাবিতে রাস্তায় নামে; এই সুযোগে অহরহ শ্রমিক জনতা প্রতিবাদী নারীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে মিছিলে অংশগ্রহণ করে। লেলিন আর স্টালিনের নেতৃত্বে এ বিপ্লবের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। রুশ বিপ্লব সফল, আর দ্বিতীয় নিকোলাস অর্থাৎ জার শাসন ধ্বংস হয়। এ ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্র তত্ত্ব বা বস্তুবাদ তত্ত্বের রাজনীতি চর্চা শুরু হলে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার বাঙালি নেতা মানবেন্দ্র নাথ রায় প্রথম সামাজতান্ত্রিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন এবং কমরেড মুজাফফর আহমদের নেতৃত্বে সামাজতান্ত্রিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। একই বছর ১৭ অক্টোবর সোভিয়েত অঙ্গরাজ্য উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে ভারতবর্ষ সমাজতান্ত্রিক দলের জন্ম হয়। অনেকের মতে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বোম্বাই শহরে সুভরম সুধাকর বেড্ডির নেতৃত্বে ভারত সামাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়।
পরবর্তী বিভক্ত বাংলায় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ৬ মার্চ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পাটি কিংবদন্তি নেতা কমরেড মণি সিংয়ের নেতৃত্বে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ায়।
সেই আদি থেকে এই পর্যন্ত পরিপূর্ণ ভারতবর্ষ শক্ত ধর্মীয় বিশ্বাসের চাদরে ঢাকা। এখানে প্রতিটি মানুষ জন্মের সূচনায় ধর্মবিশ্বাস মস্তিষ্কে নিয়েই বেড়ে উঠেছে। নিজের প্রত্যেকটি কর্ম-ধর্ম দিয়ে বিবেচনায় আনা ভারতীয় মানুষের যেন রক্তের ধারাবাহিক অঙ্গীকার। তাই ধর্মের যুক্তি দিয়ে বিবেককে প্রশ্ন করে, বিবেকের প্রশ্ন দিয়ে কখনো ধর্মকে নয়, কারণ তাদের কাছে এটি পাপ!
উল্লেখ্য, ভারতবর্ষে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে যারা দলে দলে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছিল ওদের মাথায় কি পরকাল ও ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়টি কাজ করেছিল নাকি ধর্মের নামে জাত-পাত ও ব্রাহ্মণ রাজার অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে এসেছিল? স্বামী বিবেকানন্দের লেখায় এ প্রশ্নটির উত্তর সুন্দরভাবে আছে। ভারতবর্ষের মানুষ ব্রাহ্মণ রাজার ধর্মীয় শ্রেণিভেদ শাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিল। তাই এটি শ্রেণী সংগ্রামের বিপ্লব। তবে ধর্ম বাদ দিয়ে এ বিপ্লব সম্ভব ছিল না, এজন্য হিন্দু ধর্মের বিপরীতে ইসলাম ধর্মের উপস্থিত। আরবে হযরত নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর জিহাদ বা যুদ্ধ অত্যাচারী জুলুমবাজের বিরুদ্ধে। তৎকালে দাসপ্রথা, উচ্চবংশ- নিচুবংশ এবং ৩৬০ দেবদেবীর ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রেখেছিল কোরাইশ দলপতিগণ। কোরআন আল্লাহর বাণী যারা বিশ্বাস করেন ভালো, আর যারা করেন না তাদেরও অবশ্যই স্বীকার করতে হবে আরবে নবী মুহাম্মদ (সঃ) মক্কা বিজয় অত্যাচার জুলুমের বিরুদ্ধে এক সফল শ্রেণী সংগ্রাম। এই সফলতার কারণে দেবদেবী পূজা ধ্বংস করে নতুন গ্রহণযোগ্য ধর্মগ্রহণ। কারণ দেবদেবী ধ্বংস না করলে মানুষ পুনরায় ঐ রীতির মায়াজালে পড়তে পারে।
ধর্মেরভিত্তিতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। ভাষা, জাতি, সংস্কৃতির বিবেচনায় রাষ্ট্র ভাগ হলে বাংলা- আসাম-ত্রিপুরা নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের অধিকার বেশি অর্থাৎ সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র বাংলাই হতো। তৎকালীন সময়ে আমাদের প্রধান নেতারাও ধর্মকে প্রাধান্য দিতে বাধ্য ছিল; হোক সে এপার মুসলিম অথবা ঐ পার হিন্দু। অবশ্য প্রগতিশীল মন-মননের নেতা বা কবি সাহিত্যিক গুণীজন যে ছিলেন না – তা নয়। তারা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে ¯্রােতে গা’ ভাসিয়ে ভিটা বদল করেন। যেমন অনেকের মধ্যে দুজনের নাম উল্লেখ করলাম। একজন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু আরেক জন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দেশ ত্যাগ না করলে জ্যোতি বসু কোন দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতেন না আর কবি নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে না এসে পশ্চিম বঙ্গে থাকলে ভারতের জাতীয় কবি হতেন না।
বাঙালি বামপন্থীর ধর্ম: উল্লেখ্য যারা বাম বা সামাজতান্ত্রিক দল ভারতবর্ষ এবং বাংলায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ওনারা মার্কস এঙ্গেলসকে পরিপূর্ণ অনুসরণ করে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের মতো একটি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন। লেলিন, স্টালিন এবং পরবর্তী উত্তরসূরি সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতাবানদের সহিত যোগাযোগও রক্ষা করেছিল যথাযথ। উনাদের গাইড লাইনে পরিচালিত হতো এখানকার সামাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চিন্তার রাজনৈতিক ভাবাদর্শ। পেরেস্ত্রাইকা সংস্কারে রাশিয়ার ভাঙ্গনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পাটি দিশেহারা হয়ে কমরেড সাইফুদ্দিন মানিকের নেতৃত্বে ড. কামাল হোসেনের গড়া গণ ফোরামে ডুবে যায়। বাংলাদেশের অনেক জাদরেল কমিউনিস্ট নেতা ড. কামাল হোসেনের তত্ত্ব ¯্রােতের চাপা পড়ে আর রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ হয়নি। বৃটিশ শাসন আমলে বাম বা সমাজতান্ত্রিক দল সরকারের চক্ষুশূল ছিল এবং পাকিস্তান আমলে ছিল নিষিদ্ধ। মুক্তি যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মার্কস-লেলিন তথা সোভিয়েত রাশিয়াপন্থীদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের প্রথম দশ বছর বাম রাজনৈতিক দলের স্বর্ণযুগ বলা চলে। অথচ এ ¯্রােত তারা পরবর্তীকালে ধরে রাখতে পারেননি। প্রতিটি সাধারণ শ্রমিক, খেটে খাওয়া দিনমজুর জনগণ শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল।
১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন বাম বা সামাজতান্ত্রিক দলে অপব্যখ্যার এক কঠিন কুঠার আঘাত আনে। বুর্জোয়া গণসংগঠনে গরিবের সন্তান মেধাবী হলেও নেতৃত্বের সুযোগ পায় না। দেশের অধিকাংশ মানুষ গরিব এবং উন্নত বিশ্বের তুলনায় দরিদ্র সীমার নিচে জীবন যাপন করে। তাই সবাই স্বপ্ন দেখে শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যমে একটি শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা। যখন সুযোগে ধর্মভিত্তিক ইসলামী দল মানুষের কাছে ইসলামিক শ্রেণি সংগ্রামের কথা বলে তখন ধর্মপ্রিয় সাধারণ মানুষ সহজে গ্রহণ অর্থাৎ কবুল করে নেন। এছাড়াও বাম রাজনীতিকে সরাসরি নাস্তিক, ধর্মহীন বলে মিছিলে-মাহফিলে ফতোয়া দিলে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ ভাবে সত্যি তো! রাজনীতির আদর্শ খাতায় ধর্ম পালনের কথা নেই, রাজনীতির সভা সমাবেশে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নেই। বাঙালি মুসলমান তো সব কিছুতেই ধর্ম থাকুক এটাই চায়! টিয়া পাখির ঝাঁকের মতো সাধারণ জনগণ শ্রেণী সংগ্রাম প্রত্যাশীরা ধর্মভিত্তিক ইসলামী সংগঠনের ছায়াতলে জমায়েত হয়। সাধারণ জনগণের সমর্থন থাকলেই তো শ্রেণী সংগ্রাম সংগঠন টিকে থাকে। অথচ আজকে বাংলাদেশের বড় বড় বাম রাজনৈতিক নেতা হজ্ব পালনের জন্য আরবে যায়। বয়স সত্তর পেরিয়ে গেলে মসজিদে ঢুকে নিজের জানাজায় মানুষের ঢল জমায়েত পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করে।
সাহিত্যিক আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমানের মন নামক লেখায় বাংলার বিবেক আবুল ফজলের শেষ বয়সে ইসতেমায় অংশগ্রহণ করাকে ফুটিয়ে তুলে প্রমাণ করেছেন ধর্মকে বাঙালির রক্ত-মাংস থেকে আলাদা করা যায় না। কোন বাম রাজনৈতিক নেতা রাজনীতি থেকে ধর্ম আলাদা একথা ধর্মবিশ্বাসীদের বুঝিয়ে কূলকিনারা অন্তত সামনে আরো একশত বছর পাবে না, তাই এটি বুঝতে পেরেই বামপন্থীরা হতাশায় এ অবস্থা। অতীতে একশত বছর আগে বাম বা সমাজতান্ত্রিক দল প্রতিষ্ঠাতাদের বোঝার বিষয় ছিল যে, মার্কসের শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব ভারতের সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে একটি আত্মনির্ভরশীল দল গড়ার চেষ্টা করা। এটাই প্রয়োজন ছিল। কে একজন বলেছিল ( শাহ মোয়াজ্জেম ) মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকা ছাতা মাথায় দেয়। বতর্মানে যে সব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যায় তারাও তো কাগজে কলমে ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে রাখে, আসলে বিভক্ত ভারতের কোথাও কি কখনো ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র চলেছে? যে সব ধর্মীয় সংগঠন, যেমন ভারতে বিজেপি সরকার ওখানে কি ধর্ম বিধানে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়? বাংলাদেশের ইসলামিক দল ক্ষমতায় যাইনি, মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ধর্ম পালনীয় বিষয় ছাড়া রাষ্ট্রীয় কোন কাজটি পৃথিবীর ¯্রােত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শতভাগ ইসলামে রূপান্তরিত করতে পারবে? ভারতবর্ষ ভারতবর্ষের মতো, এখানে রাজনীতি মানুষের মনের বিশ্বাসের সাথে তাল মিলিয়ে চলে, তত্ত্বজ্ঞানের গভীরে পৌঁছানো এখনো মানুষ পাপ ভাবে!
লেখক পরিচিতি: নাছির উদ্দীন, কবি ও প্রাবন্ধিক।
Discussion about this post