চট্টগ্রাম,১৪ জানুয়ারি, ২০২৩:
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে একই পরিবারের ৫ জন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পারুয়া ইউনিয়নের তিন নং ওয়ার্ডের উত্তর পারুয়ার মহাজন পাড়ার কাঙ্গাল বসাক (৭০), কাঙালের স্ত্রী ললিতা বসাক (৬০) নিহতদের পুত্রবধূ লাকী বসাক (৩২), লাকির ছেলে সৌরভ বসাক (১২) ও মেয়ে সায়ন্তী বসাক (৪)।
একই সঙ্গে অগ্নিদগ্ধ হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন কাঙ্গাল বসাকের পুত্র সিএনজি অটো রিকশা চালক খোকন বসাক(৪২)। নিহতদের মধ্যে কাঙাল ও ললিতা বসাক খোকনের বাবা-মা, লাকি তার স্ত্রী ও তাদের ছেলেমেয়ে। মা-বাবা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে দের হারিয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
শুক্রবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
পেশায় সিএনজি অটোরিকশা চালক খোকন বসাক বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে সেমিপাকা ঘরে বসবাস করতেন। তিন কক্ষবিশিষ্ট ঘরটিতে বহির্গমন দরজা ছিল মাত্র একটি। সেই দরজা সন্নিহিত ছিল তাদের রান্নাঘর। রান্নার চুলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা বলে ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিকভাবে মনে করছে।রাঙ্গুনিয়া ফায়ার স্টেশনের ইনচার্জ কামরুজ্জামান সুমন জানান, রাত ২টা ১০ মিনিটের দিকে টিনশেড ঘরে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৫টি গাড়ি ঘটনাস্থলে যায়। দরজা ভেঙে একজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ভোররাত ৪টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
এর আগে খোকন বসাককে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। অগ্নিনির্বাপণ শেষে ঐ পরিবারের ৫ জনের মৃতদের উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, রান্নাঘরের চুলা থেকে আগুন লেগে সেখানে মজুদকৃত বিপুল পরিমাণ কাঠের লাকড়ির মাধ্যমে আগুন পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু ঘরে দরজা ছিল একটাই আর সেই দরজা ঘিরেই আগুনের মূল উৎসস্থল।
পারুয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জাহেদুল রহমান তালুকদার জানান, ‘স্থানীয় অটোরিকশা চালক খোকন বসাকের বাড়িতে রাত আড়াইটার দিকে আগুন লাগে। বাড়িতে শুকনো পাতা দিয়ে রাতের রান্না হয়েছিল। পরে সেই আগুন পুরোপুরি নিভিয়ে না যাওয়ায় তা থেকে আগুন ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাড়িতে একটিই দরজা। সেই দরজার মুখে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় আগুন লাগে। ধারণা করা হচ্ছে অটোরিকশার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। যার কারণে কেউ ঘর থেকে বের হতে পারেননি। গভীর রাত হওয়ায় প্রতিবেশি ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মী আসার আগেই সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আগুনে সিএনজিটিও পুড়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা বিজয় সেন বলেন, ‘গভীর রাতে অগ্নিকা-ের ঘটনা শুনে তাদের উদ্ধার করার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হই। ঘরের একটি মাত্র দরজা হওয়ায় তাদের উদ্ধার করতে সমস্যা হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন শামীম ও রাঙ্গুনিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মাহাবুব মিল্কি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউল গণি ওসমানি জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে মৃত ব্যক্তিদের সৎকারের জন্য ২৫ হাজার টাকা নগদ অর্থ সহায়তা দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খোকন বসাক বাবা মা স্ত্রী সন্তানদের হারিয়ে পাগল প্রায়। অন্যদিকে আগুনে পোড়া শরীরের অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বলেন, দুই শিশু সন্তানের ডাকে ঘুম ভাঙলে দেখেন ঘর জ্বলছে আগুনে। এরপর তাদেরসহ বাবা-মা ও স্ত্রীকে নিয়ে জড়ো হন বারান্দায়। সেখান থেকে বের হওয়ার পথটিতে তখন ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখা। আগুনে পুড়ছে তখন অন্য কক্ষগুলোও। আর কোনো উপায় না দেখে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন খোকন বসাক। ছেলেমেয়ে সহ সকলকে পিছু পিছু আসতে বললেও তারা আর লেলিহান আগুন পেরিয়ে বের হয়ে আসতে পারেনি। তিনি বলেন, আগুন লাগার পর ছেলে ও মেয়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গে খোকনের। ১২ বছরের ছেলে সৌরভ ও পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে সায়ন্তি। হঠাৎ ‘বাবা আগুন, বের হও …‘ সেই ডাকেই ঘুম ভেঙ্গেছিল খোকনের। যারা ডেকে তাকে বাঁচিয়েছিল, তাদের রক্ষা করতে না পারার আগুনে পুড়ে মরছেন খোকন এখন। এজন্যই হাসপাতালে তার বিলাপ।
পিছুপিছু দুই সন্তান ও অন্যদের আসতে বলে খোকন আগুনের ভেতর দিয়ে দরজা পার হন। তবে আগুনের ভয়াবহতা এতটাই বেশি ছিল যে বারান্দায় থাকা বাকি পাঁচজন দরজার কাছে ভিড়তেই পারেননি। বাইরে থেকে নলকূপের পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেও কূলিয়ে উঠতে পারেননি। ডাকাডাকি করলেও রাতে প্রতিবেশীদের এগিয়ে আসতে আসতে তিনি স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মাকে বাঁচাতে না পারার অনুশোচনার আগুনে পুড়ছেন।