৯ অক্টোবর,২০২১, চট্টগ্রাম:
দুর্নীতির মামলায় বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি(২১ তম) সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ১১ বছরের সাজা হয়েছে। ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের মামলার মঙ্গলবার তাকে ১১ বছরের কারাদ- দিয়েছে ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালত।
এর মধ্যে ঋণ জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাতের দায়ে চার বছর এবং মানিলন্ডারিং ধারায় সাত বছরের কারাদ- দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৪-এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম এ রায় ঘোষণা করেন।
দুটি সাজা একসঙ্গে চলবে বলে তাকে সাত বছর কারাদ- ভোগ করতে হবে বলে জানান আইনজীবীরা।
এছাড়া সিনহাকে দুই অভিযোগে ৪৫ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ছয় মাস কারাদ- এবং ফ্রিজ থাকা ৭৮ লাখ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়।
মোট ১১ আসামির এই মামলায় অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে ও ২ আসামি খালাস পেয়েছেন। খালাস প্রাপ্তরা হলেন- টাঙ্গাইলের মো. শাহজাহান এবং নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা।
এ দুজনের নামেই মূলত চার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন হয় ফারমার্স ব্যাংক থেকে। ফারমার্স ব্যাংকের প্রায় চার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দ-িত হলেও খালাস পেয়েছেন এই মূল দুই ঋণগ্রহীতা।
এ দুজনের খালাস পাওয়ার বিষয়ে দুদক কৌঁসুলি মীর আহমেদ আলী সালাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তারা ভিক্টিমাইজ। তারা কোর্টে এসে স্বীকার করেছেন যে, আমরা কিছুই জানতাম না। আমাদের শুধু ব্যাংকে গিয়ে কতগুলো কাগজে সই করতে হয়েছে। এই অ্যাকাউন্টে কীভাবে টাকা এলো এবং সেই অ্যাকাউন্ট থেকে কীভাবে সাবেক প্রধান বিচারপতির অ্যাকাউন্টে টাকা গেলো, পে-অর্ডারের টাকা কোথায় গেলো, সে বিষয়ে তারা কিছুই জানতো না।
চার কোটি টাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গেই তা পে-অর্ডার করা হয় এবং সেই টাকা এসকে সিনহার সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখার অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়। জমা টাকা ক্যাশ করে একাংশ উত্তরা শাহজালাল ব্যাংকে সিনহার ভাই ও ভাতিজার যে অ্যাকাউন্ট ছিল সেখানে জমা দেন। এছাড়া তিনি সঞ্চয়পত্র কিনেছেন এবং অন্যান্য কাজে ব্যয় করেছেন।
সাজাপ্রাপ্ত অন্য আসামিদের মধ্যে – ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি একেএম শামীমকে চার বছরের কারাদ- দেওয়া হয়েছে। ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, ফারমার্স ব্যাংকের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায় এই সাত আসামির প্রত্যেকের তিন বছরের কারাদ- দিয়েছেন আদালত।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা সহ সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে সাফিউদ্দিন আসকারী, রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায় পলাতক রয়েছেন।
আসামিদের মধ্যে বাবুল চিশতি কারাগারে ছিলেন, তাকে এদিন আদালতে হাজির করা হয়। এছাড়া জামিনে থাকা অপর ছয়জন রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন। এ সাতজনকেই সাজা পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
অর্থ আত্মসাত ও পাচারের এই মামলার রায় ঘোষণার দিন এর আগে দুই বার পরিবর্তন করা হয়। দ্বিতীয় দফায় গত ২১ অক্টোবর রায় প্রস্তুত না হওয়ায় এবং প্রথম দফায় গত ৫ অক্টোবর বিচারক অসুস্থ থাকায় রায় ঘোষণা হয়নি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ (দুদক) ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য প্রথম দফায় ৫ অক্টোবর দিন ধার্য করা হয়।
আদালত সূত্র জানায়, গত বছরের ১০ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণের নামে চার কোটি টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে এসকে সিনহার ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তরের অভিযোগে মামলাটি করে।
একই বছরের ৯ ডিসেম্বর তদন্ত শেষে আদালতে মামলার চার্জশিট দাখিল করেন দুদক পরিচালক মো. বেনজীর আহমেদ। বিচার শুরু হয় গত বছরের ১৩ আগস্ট মামলায় এসকে সিনহাসহ ১১ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠনের মাধ্যমে। মামলায় ২১ আসামির মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয় গত ২৪ আগস্ট।
ঋণ জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাতের দায়ে চার বছর এবং মানিলন্ডারিং ধারায় সাত বছর কারাদ-ে দ-িত সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার এই ঘটনা ‘নজিরবিহীন’ বলে বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। সাধারণত পৃথিবীর কোথাও কোথাও প্রধান বিচারপতিকে(দায়িত্বকালীন) অভিশংসন(ইমপিচমেন্ট) করার কথা জানা যায়।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার ১১ বছরের কারাদ-ের প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আই অ্যাম নট ভেরি হ্যাপি। কারণ বিচার বিভাগের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন, তিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন। আমি একজন আইনজীবী, বিচার বিভাগের সঙ্গে সারাজীবনই সম্পৃক্ত। আমার জন্য এটি সুখকর হতে পারে না।
তিনি বলেন, অন্যায় করলে বিচার হবেই। প্রমাণিত হচ্ছে- কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, এটি অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।
মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের আইনমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইতিহাসে কোনো বিচারপতি এ রকম অন্যায় করেননি। যে কারণে বিচার করার প্রয়োজন হয়নি। অন্যায় হলে নিশ্চয়ই বিচার হতো। পৃথিবীতে অনেক নজির আছে। যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে-ফ্রেঞ্চ রেভুল্যশনেও দেখবেন, সেটি এখানে বড় কথা নয়। সেটিকে উদাহরণ হিসেবেও আনা উচিত নয়।
মামলার রাষ্ট্রপক্ষে দুদকের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ না। অপরাধী যতো বড় শক্তিশালী হোক না কেন, যত বড় পদেই আসীন থাকেন না কেন, আইনের আওতায় তাকে আসতে হবে। যদি অপরাধ প্রমাণিত হয়, সাজা ভোগ করতে হবে। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি পদে থাকাকালে তার যে অবস্থান সেই অবস্থানে থেকে যে কাজগুলো করেছেন, সেটা প্রসিকিউশন সাকসেসফুলি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে বলেই সাজা হয়েছে। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি।
১৯৭৪ সালে সিলেট বারে আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে হাই কোর্টে এবং ১৯৯০ সালে আপিল বিভাগে তালিকাভুক্ত হন এস কে সিনহা। হাই কোর্টে তিনি বিচারক হিসাবে নিয়োগ পান ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর। আপিল বিভাগে আসেন ২০০৯ সালের ১৬ জুলাই।
ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আপিল বিভাগের যে বেঞ্চ বাতিল করেছিল, এস কে সিনহা ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। এছাড়া ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় দেওয়া বেঞ্চেও সদস্য ছিলেন তিনি।
আপিল বিভাগে আসার ছয় বছর পর ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন এস কে সিনহা।
এস কে সিনহা বিদেশে যাওয়ার দুই বছর পর এ মামলা দায়ের করেছিল দুদক। এরপর গতবছর ১৩ অগাস্ট ১১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়। এসকে সিনহাকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার চলে।
পদত্যাগের চার বছর পূর্ণ হওয়ার ঠিক দুদিন আগে অর্থ আত্মসাতের এ মামলায় তার সাজার রায় ঘোষণা করা হল। সূত্র: বিডিনিউজটুয়েন্টিফোরডটকম, বাংলানিউজটুয়েন্টিফোরডটকম, দৈনিক যুগান্তর।
Discussion about this post