চট্টগ্রাম,০১ জানুয়ারি, ২০২৪:
‘কৌটিল্য’ বা চানক্য সেন, ‘অর্থশাস্ত্র (Arthashastra)’, বললেই ব্যাপারটা একদম পানির মত পরিষ্কার। “তোমার প্রতিবেশি তোমার শত্রু, তোমার শত্রুর শত্রু তোমার বন্ধু।” কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রকে বলা হয় ‘রাজনীতির বিজ্ঞান (The Science of politics).
.
কৌটিল্য (Kautilya) ছিলেন ভারতীয় কূটনৈতিক পণ্ডিত। খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মৌর্য সাম্রাজ্য (৩২৬-২৯৮ BC) প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পরামর্শদাতা এবং ব্রাহ্মণ রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ছিলেন তিনি। ইতিহাসে তিনি চানক্য সেন নামেই অধিক পরিচিত। উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ‘আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট’ এর সাথে দেখা করেন। কিন্তু কোন কারণে আলেকজান্ডার অসন্তুষ্ট হন এবং তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পালিয়ে যান এবং বিন্ধারণ্যে আশ্রয় নেন। এদিকে নন্দ বংশের শেষ রাজা ধননন্দের কাছে অপমানিত হয়ে প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা করে কৌটিল্যও সেসময় বিন্ধারণ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের দেখা হয়। কৌটিল্য চন্দ্রগুপ্তকে তক্ষশিলায় নিয়ে যান, এবং নিজের পরিকল্পনা খুলে বলেন। ঠিক সেসময় আলেকজান্ডার ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে অভিযানে ছিলেন। কৌটিল্যের পরামর্শে চন্দ্রগুপ্ত স্থানীয় অধিবাসীদের সংঘব্ধ করে একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। আলেকজান্ডার পাঞ্জাব থেকে চলে যাওয়ার কিছু পরেই চন্দ্রগুপ্ত এবং কৌটিল্য ধননন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। যুদ্ধে ধননন্দ নিহত হয় এবং মগধ কিংবা পাটালীপুত্রের সিংহাসনে চন্দ্রগুপ্ত আরোহন করেন, এভাবে মৌর্যবংশের শাসনের সূত্রপাত হয়।
.
১৯০৫ সালে ভারতের মহীশূর রাজ্য থেকে অধ্যাপক ড. শ্যামশাস্ত্রী অর্থশাস্ত্র বইটিকে উদ্ধার করেন। এবং ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ নামে প্রকাশ করেন। সাধারণত অর্থশাস্ত্রের লেখকরা পৃথিবীতে ব্যক্তির সমৃদ্ধি অর্জন, রাজাদের সাফল্য, রাজার অগ্রগতি এসব নিয়ে আলোচনা করেন। পণ্ডিতরা স্বীকার করেন যে, কৌটিল্যই এখন পর্যন্ত অর্থশাস্ত্রের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। বইটি ১৫ টি পরিচ্ছেদ এবং ১৮০ টি প্রকরণে বিভক্ত। প্রকরণগুলো ১৫০ টি অধ্যায়ে বিভক্ত। মাঝে মাঝে কিছু শ্লোকও আছে যার সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। মূলত কোটিল্যের অর্থশাস্ত্র হল হল প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রচিন্তার এক মহাশাস্ত্র। .
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দু’টি বিখ্যাত বই হচ্ছে প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ এবং নিকোলো ম্যাকিয়াভেলী’র ‘দ্যা প্রিন্স’। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এ দু’টো বইয়ের সাথে তুলনীয়। কৌটিল্যের মতে, রাজ্য জয়, রাজ্যের সংহতি রক্ষা, পররাজ্যের আক্রমণ ঠেকানো এবং রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কিত বিদ্যাই হল অর্থশাস্ত্র। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মূলনীতি গুলোকে আমরা নিচের পয়েন্টগুলো দিয়ে ভাগ করতে পারি:
১. রাজনীতিই হল রাষ্ট্রের অন্য সকল বিষয়ের নির্ধারক; Politics is the main Actor
২. রাষ্ট্র যুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট এবং রাষ্ট্র বড় হওয়াই উচিৎ; the origin of state is through war and a state must be big
৩. রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা এবং বিস্তারের জন্য সশস্ত্র শক্তির প্রয়োগ এবং হত্যা সম্পূর্ণ বৈধ; armaments, the license of killing your enemy
৪. রাজার ব্যক্তিগত শিক্ষা এবং যোগ্যতাই যথার্থ রাষ্ট্র শাসনের পূর্বশর্ত; to run a state well, a King must have good principles
৫. রাষ্ট্র শাসনের জন্য দক্ষতার সাথে মন্ত্রী এবং আমলাদের গড়ে তোলা এবং এদের সাথে পরামর্শ করা রাজার কর্তব্য; make ministers with great capability and take your decisions after discussing with them
৬. রাজা প্রজাদের সাথে ভাল ব্যবহার করবেন কিন্তু কোন প্রজা অবাধ্য হলে তাকে হত্যা করতেও কোন দ্বিধা করবেন না; King should be soft hearted but in times of disobey he should be hard hearted
৭. রাষ্ট্র শাসনের ব্যাপারে ধর্ম এবং নৈতিকতার কোন স্থান নেই; Religion and Morality has no rule in terms of Politics and a state
.
কৌটিল্য মূলত একজন বাস্তববাদী (Realist) ছিলেন। তাকে কোনভাবেই আদর্শবাদী (Idealist) বলা যায় না। ভারতীয় রাষ্ট্র চিন্তায় কৌটিল্যই প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ প্রদান করেছেন। কৌটল্য সুপারিশ করেন যে, কোন রাজা যদি প্রতিবেশী রাজা কর্তৃক আক্রমণের ভীতির সম্মুখীন হন তিনি সেই রাজাকে কোন উৎসব, বিবাহ অথবা হাতি শিকারের জন্য ছলে নিজ রাজ্যে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসে বন্দী করবেন, এমনকি তাকে হত্যা করবেন। এভাবে কৌটিল্য শত্রুর উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতারণা ও চাতুরীর আশ্রয় নেয়ার মত অনৈতিক কাজে লিপ্ত হবার পরামর্শ দিয়েছেন। তাই আধুনিক যুগে ম্যাকিয়াভেলি কিংবা মর্গেনথু যেমন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাস্তববাদী চিন্তাধারার গুরু, কৌটিল্যকেও তেমনি বাস্তববাদী (Realism) ধারার অন্যতম আদিগুরু বলা যায়।প্রাচীন হিন্দু রাজনৈতিক চিন্তাবিদরা রাষ্ট্রের সাতটি উপাদান আছে বলে উল্লেখ করছে। এগুলো কে অঙ্গ বা Soul কিংবা আত্মাও বলা হয়। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে এই সাতটি উপাদানের কথাও লিপিবদ্ধ করেন। এগুলো হচ্ছে:
১. শাসক (Swami বা স্বামী, king): কৌটিল্য রাজাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ রাজাই ধর্ম (I am State, Louis XIIII)। রাষ্ট্রকে সার্বভৌম হতে হলে একজন প্রধান থাকা দরকার। তিনিই দণ্ড প্রয়োগের মাধ্যমে সবরকম অরাজকতা থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে পারেন।
২. মন্ত্রিবর্গ (Amatya বা অমাত্য, minister): কৌটিল্যের মতে সহকারিদের সাহায্য নিয়েই রাজ্যশাসন সম্ভব; সুতরাং রাজার উচিৎ রাষ্ট্রিয় বিষয়ে পরামর্শ নেয়ার জন্য মন্ত্রিমণ্ডলী নিয়োগ দেয়া।
৩. জনপদ (Janapada, Territory, Land): জনপদ রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য। কেননা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপরেই সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে জনপদ বলে ভূখণ্ড এবং জনসংখ্যা দুটোকেই বোঝানো হয়েছে।
৪. দূর্গ (Durga, Fort): কৌটিল্যের মতে রাজাকে অবশ্যই একটি সুরক্ষিত দূর্গ বানাতে হবে। তার মতে রাজস্ব, সৈন্যবাহিনী, যুদ্ধ পরিচালনা, মিত্রদের কাছ থেকে সাহায্য নেয়া, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা সব কিছুই দূর্গের উপর নির্ভর করে।
৫. কোষ (Kuse, Treasury) : এটা মানে কোষাগারকেই বোঝানো হয়েছে। কৌটিল্যের মতে, ন্যায় সঙ্গত ও বৈধভাবে সংগৃহীত ধনসম্পদ রাজার কাছেই থাকবে। রাজার সমৃদ্ধ কোষ থাকা উচিৎ এবং সেটা মণি মুক্তা, স্বর্ণ- রৌপ্যয় পরিপূর্ণ থাকতে হবে।
৬. সৈন্যবাহিনী (Danda, Military): সৈন্যবাহিনী রাষ্ট্রের অন্যতম একটি মৌলিক উপাদান হিসেবে ধরা হয়। এর সাহায্যেই রাজা অন্য রাজ্যকে বশে রাখতে পারেন। কৌটিল্য বলে ৮ ভাবে সৈন্যবাহিনী গঠিত হতে পারে- ১. পদাতিক বাহিনী ২. দেশয় সৈন্য ৩. বাধ্যকৃত শ্রমিক ৪. ভাড়াটে সৈন্য ৫. হাতি ৬. ঘোড়া ৭. নৌযান।
৭. মিত্র (Mitra, Alliance): মিত্র বলতে বন্ধুর কথাই বলা হয়েছে। কৌটিল্যের মতে মিত্র হবে বংশানুক্রমিক ও অকৃত্রিম। দরকারের সময় সাহায্যের জন্য যে প্রস্তুত থাকে এবং যার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কোন আশঙ্কা থাকে না, সে হল মিত্র।
২য় পর্ব
.
পৃথিবীতে সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা শুরুর সময় থেকেই পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। প্রাচীন ভারতেও পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আলোচনা পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতের পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে কৌটিল্যের নাম সব তর্ক- বিতর্কের উর্দ্ধে। কূটনীতি বিষয়ক বর্ণনায় কোটিল্যের অর্থশাস্ত্র সর্বশ্রেষ্ঠ। কোটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে সুসংহত বৈদেশিক নীতির (Integrated Foreign Policy) এর কথা বলেছেন। তিনি বৈদেশিক নীতির ভিত্তি হিসেবে যৌক্তিকতা, কূটনীতি ও যুদ্ধকে চিহ্নিত করেছেন। কৌটিল্যের কূটনীতির মূল উদ্দেশ্য হল, এমন এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যে রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের উপর ক্ষমতাগত প্রাধান্য বজায় রাখতে পারবে। মূলত কৌটিল্য জাতীয়তাবাদী (Nationalism) মনোভাবকেই শক্তিশালী রাষ্ট্রগঠনের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
.
রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি আলোচনায় কৌটিল্য বলেন, “… of these agreement with pledges and peace, offensive operation is war, indifference is neutrality, making preparation is marching, seeking protection another is alliance and making peace with one and waging war with another is termed as double policy.” কৌটিল্য বলেন ছয় ধরণের লক্ষকে সামনে রেখে পররাষ্ট্রনীতি বা বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এগুলো ‘ষষ্ঠাঙ্গনীতি’ হিসেবে পরিচিত। এগুলোকে আমরা এভাবে সাজাতে পারি, ১. সন্ধি (শান্তি) ২. বিগ্রহ (যুদ্ধ) ৩. যান (অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি) ৪. আসন (নিরপেক্ষতা) ৫. দ্বৈধীভাব (দ্বৈতনীতি) ৬. সংশ্রয় (আত্মরক্ষার আশ্রয়)।
.
১. শান্তি বা সন্ধি (Peace or Treaty): কৌটিল্যের মতে, পাশাপাশি দুটি রাষ্ট্র যদি শত্রু ভাবাপন্ন থাকে এবং সমান ক্ষমতাশালী হতে চায়, তাহলে উক্ত দুদেশের মধ্যে শত্রুতার পরিবর্তে পারস্পরিক শান্তি স্থাপনের মাধ্যমে উভয়ের অধিকাংশ উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে। কারণ শান্তি বজায় থাকলেই রাজা রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক কাজে মনোযোগ দিতে ও সম্পাদনা করতে পারবেন। প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সাথে শান্তিকালীন সময়েই রাজা শত্রুরাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রম নস্যাৎ করার জন্য গুপ্তচরবৃত্তিতে মনোযোগ দিতে পারে। কৌটিল্যের মতে সন্ধি হল দু’জন রাজার মধ্যে একটি পণবন্ধন। সাধারণত কোষ, ভূমি ও দণ্ড দানের শর্তের মধ্যে দিয়ে এ পণবন্ধন সম্ভব।
২. যুদ্ধ (War): কোটিল্য বলেন, যদি রাজার প্রচুর সৈন্য থাকে, দেশের মানুষের রাজার প্রতি সহযোগিতার মনোভাব থাকে এবং উক্ত দেশের নিরাপত্তা যদি পাহাড়, নদী, সমুদ্র, বনাঞ্চল এবং দূর্গ দ্বারা নিশ্চিত থাকে এবং তিনি যদি আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকেন তবেই একজন রাজার পক্ষে যুদ্ধ করা উচিৎ। কৌটিল্য রাজাকে যুদ্ধে আক্রমণ করা আগে তার নিজের ও শত্রুপক্ষের শক্তি- সামর্থ্য ও দূর্বলতার বিভিন্ন দিক বিচার – বিশ্লেষণ করতে হবে। প্রয়োজনবোধে অন্যরাজার সাথে সন্ধি (Alliance) করতে হবে। কৌটিল্যের মতে যুদ্ধ কাম্য নয়, তবে যেকোন মুহূর্তে সেটা হতে পারে।
৩. যুদ্ধের প্রস্তুতি বা যান (Marching and Preparation): যদি কোন রাজা নিশ্চিত হন যে এ মুহূর্তে শত্রু রাজার রাষ্ট্রে সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঢুকে রাজার সম্পদের ক্ষতি সাধন করতে পারবেন এবং যদি নিশ্চিত হতে পারেন যে অপর পক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবেন তবে উক্ত রাজার সৈন্যবাহিনী সহ অগ্রসর হওয়া উচিৎ। শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতিকে কৌটিল্য ‘যান’ বলে অভিহিত করেছেন। কৌটিল্যের মতে শত্রুরাজ্য যখন অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ – বিক্ষোভে বিপন্ন হবে বা বিপদে পড়বে তখনই তাকে আক্রমণের উপযুক্ত সময়।
৪. আসন বা নিরপেক্ষতা (Neutrality): কৌটিল্যের মতে একজন রাজা তখনই ‘নিরপেক্ষতা’ কে বৈদেশিক নীতি হিসেবে নিতে পারেন, যখন অন্যদেশের সাথে তার যুদ্ধ বাঁধলে যুদ্ধের প্রকৃতি হবে- কুকুর ও শুওরের মধ্যকার যুদ্দের মত। যদি রাজা দেখেন শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করতে পারবেন না তখন তিনি আসন বা নিরপেক্ষতা নীতি হাতে নিতে পারেন।
৫. দ্বৈধীভাব বা দ্বৈতনীতি (Double Policy): যদি কোন রাজ্যের অবস্থান দু’টো শক্তিশালী রাষ্ট্রের মাঝে হয় তবে উভয় রাষ্ট্রের সাথেই রাজা সন্ধি স্থাপন করবেন। তা যদি সম্ভব না হয় তবে উভয় রাষ্ট্রের শত্র এবং বিশ্বাসঘাতকদের সাথে সন্ধির মাধ্যমে উভয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবেন। এটা একধরণের কূটকৌশল।
৬. সংশ্রয় বা আত্মরক্ষার আশ্রয়: কৌটিল্যের মতে আত্মরক্ষার জন্য রাজা অধিকতর শক্তিমান বা বিশেষভাবে বলবান রাজার শরণাপন্ন হবেন এবং এ ক্ষেত্রে আশ্রয়দাতা রাজার কাছে নিজের স্ত্রী- পুত্রাদি, দ্রব্য- সামগ্রী সমেত নিজেকে অর্পণ করবেন। তবে এটা একটা সাময়িক নীতি বা ব্যবস্থা। এটাকে একধরণের Collective Security ও বলা যায়, আবার Alliance ও বলা যায়।
.
কৌটিল্যের মতে পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য হল, নিজ রাজ্যের উন্নতি ও সমৃদ্ধি সাধন। তিনি আরো বলেন, রাজা শত্রুপক্ষের উন্নয়নমূলক কার্জক্রমকে বিনষ্ট করবেন এবং নিজের রাজ্যের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে যত্নশীল থাকবেন। কোটিল্য রাজতন্ত্রের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রই (Hereditary Monarchy) তার আদর্শ। কারণ তার দৃষ্টিতে রাজতন্ত্রই সর্বাপেক্ষা কল্যাণকর মানবিক প্রতিষ্ঠান। কৌটিল্য রাজা ও সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য নগ্ন লঙ্ঘনও সমর্থন করেন। কৌটিল্য মনে করেন,
১. রাজার প্রতি যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই অসন্তুষ্ট ও রাজার ক্ষতিসাধনে লিপ্ত কর্মচারীদের গোপনে হত্যা করার নীতি পর্যন্ত তিনি অনুমোদন করেন।
২. কৌটিল্য রাষ্ট্রের শত্রুদের নির্মুল করার জন্য গোপন কূটনীতির আশ্রয় নিয়ে তাদেরকে হত্যা করার পরামর্শ দেন।
৩. কৌটিল্য রাজার শক্তি ও সম্পদ বৃদ্ধির জন্য অন্যায় ও অনৈতিক উপায় অনুসরণ করতেও রাজার প্রতি সুপারিশ করতে দ্বিধাবোধ করেন নি।
৪. কৌটিল্য রাষ্ট্রের অর্থিক সংকটের সময় বল প্রয়োগ ও প্রতারণার সাহায্যে রাজকোষ পূর্ণ করার জন্য রাজাকে উপদেশ দেন।
মোটকথা, সংকটকালে কৌটিল্য যেসব কার্যকলাপের অনুমোদন দেন তাতে প্রমাণিত হয় যে শঠতা, প্রজার সম্পত্তি লুণ্ঠন, সহিংসতা ও প্রতরণাকে তার কাছে নিন্দনীয় বা অনৈতিক বলে মনে হয় নি।
.
কৌটিল্য ও ম্যাকিয়াভেলির সরকার ব্যবস্থা অনেকাংশে মিল পাওয়া যায়। কৌটিল্য যেমন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একদম বাস্তববাদী (Realistic) ছিলেন নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে, ম্যাকিয়াভেলিও তেমনি ছিলেন। অনেক গবেষক কৌটিল্যকে ভারতের ম্যাকিয়াভেলী হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু একদল মনে করেন, কৌটিল্য ও ম্যাকিয়াভেলির নৈতিকতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কিত ধারণার মধ্যে মিল থাকলেও যেহেতু ম্যাকিয়াভেলির উনিশশো বছর পূর্বে কৌটিল্য তার রাষ্ট্রতান্ত্রিক ধারণার সূত্রাপাত করেন, সেজন্য ম্যাকয়াভেলিকেই পাশ্চাত্যের কৌটিল্য হিসেবে অভিহিত করা উচিৎ।
.
এন. সি. বন্দোপাধ্যায়ের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি, “কৌটিল্যের বিরোধিরা রাজনীতিতে অমানবিক বিষয় সমর্থনের দায়ে তাকে অভিযুক্ত করলেও তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে উচ্চতর আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যুদ্ধ পরিচালনা ও রাজনীতিতে সাফল্য অর্জনের জন্য তিনি বিভিন্ন অমানবিক কৌশলের উল্লেখ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আছে সত্য কিন্তু এগুলো তার নিজস্ব আবিষ্কার ছিল না বরং তার সকয়কার বিশ্বেরই নীতি ছিল এসব।”
বইটির মূল্য -২৬৫০/-
বিক্রি-১৮৫০/-
(আদি ও আসল ভারতীয় বই)
সংগ্রহ করতে হোয়াটসঅ্যাপ করুন…
#secular #Bangladesh #philosophy #history #Anthropology #reading$
Discussion about this post