চট্টগ্রামে খালে পড়ে এবার নিখোঁজ হল শিশু
চট্টগ্রাম মহানগরে খালে পড়ে এক বিশ্বদ্যিালয় ছাত্রীর মৃত্যু ও এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নিখোঁজ হওয়ার কয়েক মাস না যেতেই গত সোমবার ষোলো শহর রেল স্ট্রেশন এলাকায় খালে পড়ে কামাল নামে এক শিশু নিখোঁজ হবার এক দিন পরও সন্ধান মেলেনি। লাশ মিলেছে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর। শিশুকে খুঁজতে গিয়ে হয়রান ফায়ার সার্ভিস ও সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু জীবিত বা মৃত শিশুর এক খোঁজ মেলেনি।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উপর এর দায় বর্তালেও চলমান প্রকল্প হওয়ায় সবধরনের ‘মেইনটেইনেন্স’ কাজ বাস্তবায়নকারী সংস্থার বলে দাবি করেছেন সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি আরও বলেন, ‘আমি কিছু খালে পরিষ্কার করা শুরু করছিলাম। একেতো আমাদের খাল পরিষ্কারে বাজেট নেই। তার উপর সিডিএ’র প্রকল্পের অধীনস্ত খালে পরিষ্কার করতে গিয়ে বাঁধার সম্মুখীন হই। তাছাড়া কোনো সংস্থা প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে প্রকল্প এলাকার সবধরনের মেইনটেইনেন্স করবে বাস্তবায়নকারী সংস্থা।
গত সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নগরীর ষোলশহর এলাকায় চশমা খালে তলিয়ে যাওয়া শিশুর খোঁজ মেলেনি এখনও। শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য তল্লাশি চালাতে গিয়ে ইতোমধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা কয়েক টন ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করেছে। উপস্থিত থাকা কর্মীরা জানিয়েছেন, অন্তত ২০ টন বর্জ্য তোলা হয়েছে। খাল এবং এর সংলগ্ন নালায় ময়লা-আবর্জনার পরিমাণ বেশি থাকায় তল্লাশিতে বেগ পেতে হচ্ছে বলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম নগরীতে একই ধরনের আরও দু’টি ঘটনা নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। গত ২৫ আগস্ট সকালে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে নগরীর মুরাদপুরে সড়ক ও ফুটপাতের সঙ্গে লাগোয়া একটি নালায় পড়ে নিখোঁজ হন প্রায় ৫৫ বছর বয়সী সালেহ আহমদ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, আটকে থাকা বৃষ্টির পানিতে নালা ও ফুটপাত একাকার হয়ে যায়। নালার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পা পিছলে পড়ে যান তিনি। মুহূর্তের মধ্যেই প্রবল স্রোতে ভেসে যান সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমদ। ঘটনার তিনমাস পেরিয়ে গেলেও তার খোঁজ মেলেনি।
ওই ঘটনার একমাস পর গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে নগরীর ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ শেখ মুজিব সড়কে জেক্স মার্কেটের সামনে নালায় পড়ে নিখোঁজ হন সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া (১৯) নামে এক তরুণী। ফায়ার সার্ভিস তল্লাশি চালিয়ে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৭০ ফুট দূরে নালার ভেতর থেকে তার লাশ উদ্ধার করে। সেহেরীন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। এই দুটি দুর্ঘটনাতেও ১০টনের অধিক বর্জ্য খাল থেকে তোলা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। উভয় ঘটনার পর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা একে অন্যকে দায়ী করে বক্তব্য দেয়।
এদিকে সন্তানকে ফিরে পাবার আশায় খালের পাড়েই দিন কাটছে বাবা আলী কাউসারের। কিন্তু সেই আশা নিষ্ফল। আলী কাউসার বলেন, জীবিত ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, সেটা বুঝতে পারছি। আমার বাবার লাশটা যেন অন্তত পাই।
মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তল্লাশি শুরু করেন ফায়ার সার্ভিসের দু’টি ইউনিটের সদস্যরা। এরপর ডুবুরি দলের সদস্যরাও যোগ দেন। রাত ১১টা পর্যন্ত কাজের পর বুধবার সকাল থেকে আবারও তল্লাশি শুরু হয়। গতকাল থেকে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরাও খাল-নালা থেকে ময়লা-আবর্জনা অপসারণে যোগ দিয়েছেন।
চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক নিউটন দাশ জানিয়েছেন, ষোল শহরে চশমা খালের যে পয়েন্টে শিশুটি নিখোঁজ হয়েছে বলে তাদের জানানো হয়েছে, সেই পয়েন্ট থেকেই তল্লাশি শুরু হয়। সেখানে খালের সঙ্গে নালা আছে। ষোলশহর রেলস্টেশনের আশপাশ থেকে চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্সের পেছনে পর্যন্ত নালায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে। ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর সামশুল আলম জানিয়েছেন, ঘটনাস্থল এবং আশপাশের নালা থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১০ টনের ময়লা-আবর্জনা উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে প্লাস্টিকের বোতল, ককশিট ও পলিথিন। খাল থেকে ময়লা উত্তোলনে তেমন সমস্যা না হলে নালায় বেগ পেতে হচ্ছে। নালার ভেতরে ঢুকে ময়লা-আবর্জনা অপসারণে সময়ও বেশি লাগছে। তবে নিখোঁজ শিশুটি আদৌ সেখানে কোথাও ময়লা-আবর্জনার ভেতরে আটকে আছে কি না, সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, শিশুটি এখানে আটকে আছে নাকি পানিতে তলিয়ে আরও দূরে চলে গেছে সেটি বলা খুব মুশকিল। ড্রেনে এত বেশি ময়লা যে, সেগুলো অপসারণ করতে গিয়ে আমাদের খুব বেগ পেতে হচ্ছে। ড্রেনে শুধু পানি থাকলে সেটা বলা সহজ হতো।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘ষোলশহরে চশমাখালে চলমান জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় বাঁধ দেওয়া হয়েছে। সেখানে একটা ক্রস কালভার্টও আছে। এজন্য ময়লা-আবর্জনা সহজে যেতে না পেরে সেগুলো আটকে গেছে। তবে স্কেভেটর দিয়ে চশমাখাল থেকে ময়লা প্রায় তুলে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ড্রেনের ভেতরে ময়লা বেশি। সেখানে পানি কম, মাত্র দুই থেকে আড়াই ফুট হতে পারে। আমাদের মেয়র মহোদয় গতকাল (মঙ্গলবার) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে কাজ করছি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আলী কাউসার বলেন, ময়লা খুব বেশি। ময়লার জন্যই আমার ছেলেটা নালা থেকে উঠতে পারেনি। আমি নিজে নেমে ময়লার ভেতর খুঁজেছি। নালার ভেতরে এত ময়লা, সেখানে ঢোকা যাচ্ছে না। আমার বাবাটাকে যেন পাই, আর কিছু চাই না। হয়তো জীবিত আর পাব না, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু বাবার লাশটা যেন অন্তত পাই।
কামালের বন্ধু রাকিবের ভাষ্য অনুযায়ী, সোমবার বিকেল ৪টার দিকে তারা চশমা খালে বোতল কুড়াতে নেমেছিল। এ সময় বৃষ্টি হচ্ছিল এবং খালে পানি বেশি ছিল। ষোলশহর দুই নম্বর গেট থেকে দক্ষিণ দিকে চশমা খালে সাঁতার কেটে যাবার সময় তারা ফোম জাতীয় একটি বস্তু পায়। সেটা নিয়ে খেলতে খেলতে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল। রেলস্টেশনের কাছে যেখানে খালের সঙ্গে নালা মিশেছে, সেখানে স্রোত বেশি ছিল। স্রোতের টানে কামাল তলিয়ে যায়। লোহার একটি খুঁটির সঙ্গে আটকে যাওয়ায় রাকিব উঠে আসতে সক্ষম হয়।
কামাল তলিয়ে যাবার বিষয়টি ভয়ে শুরুতে সে কাউকে জানায়নি। সন্ধ্যার দিকে কামালের বাবা আলী কাউসারকে দেখে ঘটনা জানায়। এনজিও কোডেকের এক কর্মকর্তা ঘটনা জানতে পেরে পরদিন ফায়ার সার্ভিসকে জানায়। এরপর সিটি কর্পোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস শিশুটিকে খুঁজতে শুরু করে।