#সুরেশ কুমার দাশ#
সম্ভবত ১০/১২ বছর আগে শঙ্করের একটা লেখা পড়েছিলাম। সেটার কিছু ইঙ্গিত মাথায় ঘুরছে। কোন কোন পরিচয়ে বাঙালিকে চেনা যায়। অর্থাৎ যার ইলিশ প্রীতি আছে তিনিও বাঙালি। তাকে বাঙালি হিসাবে গোণা যায়। কিন্তু বাঙালির এই জাতীয় পরিচয়ের ইলিশ এখন দেশের মানুষের পাতে পাওয়া বরাতজোর বলা যায়।
ইলিশ নিয়ে আজকের বাঙালি আর কয়েক দশক আগের বাঙালির মধ্যে ভাবনার ব্যবধান দুস্তর। আগে ইলিশ নিয়ে গল্প গান, লোককাহিনী, কথাকাহিনী, কবিতা, পুথি- পাঁচালি হত, সেসব রঙরসে ভরা থাকত ইলিশের স্বাদে। অন্তত ৫০ পদের ইলিশের মুখরোচক ব্যঞ্জন তৈরির লেখা আছে নানা কথামালায়। কোন ইলিশ খেতে সুস্বাদু, আকার- আকৃতি কেমন ইত্যাদি। বেহেশতি মেওয়ায় ইলিশ নেই বলে বিখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী মনোক্ষুণ্ন ছিলেন। কিন্তু ইলিশের বেহেশত বাংলাদেশেও মীনসত্তম, রজতবর্ণ মনোহরদর্শন মৎস্যকুলরাজ মহান ইলিশের আকাল পড়েছে। হাহাকার পড়েছে। সেটাই পাড়াপাড়ি।
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের খাদ্যপণ্যের বাজারে ক্রেতাদের সাথে এক পলিটিক্যাল সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তার শিকার ইলিশও। বাজারে লুকোচাপা, নানা কূটকৌশল। ব্যবসায়িরা রাজনীতির মুখটা ঘুরিয়ে দিয়েছে জনগণের দিকে। বাজারে ঢুকলে বিষমাখা তীরের ফলা বিঁধছে ক্রেতাদের অন্তরে। সেই বাজারের ক্রেতা অঢেল টাকাওয়ালা না হলে ব্যবসায়ীর মন মজে না। তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় খাবি খাচ্ছে দরিদ্র, নিম্ন আয়ের ও মধ্যম আয়ের মানুষ।
তাই ইলিশ কোথায় গেছে তার জবাবে বিশ্বাস নেই ক্রেতাদের। এক সময় সরবরাহ ও দাম নিয়ে কোনো ভাবাভাবি ছিল না। এখন বাঙালির গোমড়ামুখ, অন্তর্জ্বালা- ইলিশ পাতে তুলতে না পারার।
তাই ইলিশ নিয়ে আজকের প্রজন্মের ভাবনায় আনন্দের কিছু নেই, হাহুতাশ ছাড়া।
এই নিয়ে সামাজিক মাধ্যমেও ব্যাপক তোলপাড় চলছে। ইলিশ নিয়ে সেই গালগল্প, রম্যহম্যে নেই তারা। কারণ বাজার আমাদের স্বাদ-আহলাদ হাতুড়ি পেটা করছে।
অথচ ইলিশ এখন বাংলাদেশের গৌরবের। যা দ্বিতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশকে বাংলাদেশী পণ্য হিসাবে বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জনের কথা জানায়। আমাদের অগ্রগতি আছে ইলিশের জিনোম আবিষ্কারে। জিআই পণ্যের স্বীকৃতিতে।
কিন্তু এমন ভরা মৌসুমে যদি এত স্বাদ ও গৌরবের ইলিশের এক টুকরোও মানুষের পাতে না মেলে তাহলে এই ইলিশ কোথায় যাচ্ছে, কাদের পাতে উঠছে তাদের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক ঘুরলেও দেখা মেলে তাদের এমন নানা প্রশ্ন। যেন ইলিশের আকাল পড়েছে। আর যারা ইলিশের স্বাদ ভুলতে পারেনি তারা ঘোড়ারোগে ভুগছে এমন মনে করারও কারণ নেই। কারণ ইলিশের সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক বন্ধন তৈরি হয়েছে বহু আগে। জাতীয়তাবাদ জড়িয়েছে। আমাদের জাতীয় মাছ তো বটেই। এমনি এমনি তো জাতীয় মাছের তকমা জোটেনি। পর্যাপ্ত উৎপাদন ও সুলভমূল্যের বিষয় ছিল। প্রায় হাজার বছর ধরে এভাবে ইলিশ বাঙালির রসনাতৃপ্তি মিটিয়েছে।
ইলিশের বাড়ি নামে এক ফেসবুক পেজে লেখা হয়েছে – ‘ইলিশ মাছ খড়-ভুসি খায় না, তেল দিয়েও চাষ হয় না, ফিড লাগে না। সাগরে বড় হয়। একাই নদীতে আসে তবুও একটা ইলিশের দাম এতো কেন, কেন একটা ইলিশ কিনতে গেলে মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিকে দুইবার ভাবতে হয়।’
জবাবে একজন মন্তব্য করেছেন-‘সুযোগ হলে ইলিশ ধরার ঘাটে গিয়ে ১ সপ্তাহ কাটাইয়েন, তাহলে বুঝবেন ইলিশ কি কি খায়। একটা বোট নামাতে কত খরচ, ইঞ্জিনের কত খরচ, তেলের কি পরিমাণ খরচ!!জেলেরা কাঁদতেছে বর্তমানে তাদের যেই খরচ গেছে সেই তুলনায় মাছ পড়ছে খুব সামান্য। আমি নিজেও গত বছর যেই দামে ইলিশ দিলাম এই বছর সেই দামে দিতে পারতেছি না। তাছাড়া ইলিশ মাছের অনেকবার হাতবদল হয় যার ফলেও দাম বেড়ে যায়। তিনি বললেন, এখন ইলিশের দাম সর্বোচ্চ কম। এর চেয়ে এই বছর কমবে বলে মনে হয় না।’
মন্তব্যকারীরা আরও লিখেছেন, ইলিশ এখন ইবলিশের খাদ্য। সিন্ডিকেট ভাঙ্গবে কে? মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটা থাকবে না।
কেউ লিখেছেন, জাতীয় মাছ থেকে ইলিশকে বাদ দেওয়া হোক। আর কেউ লিখেছেন- বাংলাদেশে এখন ফকির-মিসকিন নেই। দাম বাড়লেও কিনতে পারবে।
আহমদ হোসাইন নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘ইলিশ চাষবাসের পিছনে কোনো ইনভেস্টমেন্ট নেই। তারপরও জাতীয় মাছ ইলিশের কেজি কেন দুই হাজার টাকা।’ তিনি মধ্যস্বত্বভোগীদের দিকেও আঙ্গুল তুলেছেন।
তারা বলেছেন, বাড়তি দামের খবর যেমন আছে তেমনি প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
ইলিশ নিয়ে এক ফেসবুক পোস্টে সাড়ে চার হাজার মন্তব্যকারীকে মন্তব্য করতে দেখা গেছে।
আর একজন মন্তব্যকারী লিখেছেন, ‘ইলিশ ইউক্রেন-রাশিয়া থেকেও আসে না কিংবা ইলিশ পুকুরেও চাষাবাদ করা হয় না। নদী বা সমুদ্র থেকে জাল টেনে ধরে আনা ইলিশের দাম গরু, ছাগলের মাংস থেকেও অনেক বেশি। এর জন্য দায়ী কে ? এ এক রহস্যজনক রহস্য।’
তা মনে ধরারই কথা -‘রহস্যজনক রহস্য’।
গবেষকরাও বলেছেন- উৎপাদনে বাইরের কোনো খাদ্যের প্রয়োজন হয় না ইলিশের জন্য। সাগর ও নদীর প্রাণীকণা ও উদ্ভিদ কণা খেয়ে তারা বেঁচে থাকে।
কিন্তু এসব মন্তব্য থেকে বুঝতে পারি ইলিশ খেতে মানুষের কত সাধ-আহ্লাদ।
ভাবনায় নিলে তাদের কথা অযৌক্তিক নয়। কারণ সাগরের ইলিশ মাছের এত দাম কেন? যা অন্য কোনো খাদ্যপণ্যের সাথে তুলনা হয় না। এখন বিশ্বে এত দামি খাদ্য কী আছে?
এক সময় মিসকিন-ফকিরের পাতেও ইলিশ মাছ উঠত। এটা বেশিদিন আগের কথা নয়। কিন্তু এত এত উন্নতির মধ্যেও দিন দিন এমন কিছু পরিস্থিতি আমরা দেখছি- যা অবাক লাগে। বাংলাদেশের বাঙালির খাদ্য তালিকা থেকে অনেক খাবার উঠে যাচ্ছে। অথচ ইলিশ উৎপাদন ও ইলিশ বড় করতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। কিন্তু ইলিশ যদি মুষ্টিমেয় কিছু টাকাওয়ালার স্পেশাল খাদ্য তালিকাভুক্ত হয় তাহলে কেন এত সরকারি প্রনোদনা। তা কি শুধু টাকাওয়ালাদের খাওয়ানোর জন্যই।
আর ইলিশ উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা কী বেশি। নাকি ইলিশের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে?
একটি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে ২০২০-২১ অর্থ বছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৬৫ হাজার মে. টন। এরমধ্যে গত দশ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। বাংলাদেশে আগে বিশ্বের মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশ উৎপাদন হত। এখন উৎপাদন হচ্ছে ৮৫ শতাংশ।একই সাথে বাংলাদেশের ইলিশের গড় ওজন ৫১০ গ্রাম থেকে বেড়ে ৯১৫ গ্রাম হয়েছে।
বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে ইলিশ ধরার সহনশীল মাত্রা ৭ লাখ মেট্রিক টন হিসাব করা হয়েছে।
৭ লাখ মেট্রিক টন ধরা হলে প্রতিটি ইলিশের ওজন যদি ৫১০ গ্রামও ধরা হয় তাহলে সংখ্যায় ইলিশ ধরা পড়ে দেড় কোটির কাছাকাছি মানে ১ কোটি ৩৮ লাখ। আর ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন ইলিশ ধরা হলে ৫১০ গ্রাম হিসাবে ইলিশের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটির সামান্য বেশি। এই ১ কোটি অথবা দেড় কোটি ইলিশ বন্টন হবার কথা বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের পাতে। এই ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ১ কোটির বেশি বাংলাদেশের মানুষ বাইরে থাকে।
আর বিশ্বে ২৫ কোটি বাঙালির ইলিশের যোগান দিতে হলে বাংলাদেশের ৮৫ শতাংশের সাথে যোগ হবে আরও ১৫ শতাংশ। এই ১৫ শতাংশ ইলিশ উৎপাদন বাংলাদেশে হয় না।
বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদনের হিসাবে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত যে ইলিশ খেতে পারবে তার সম্ভাবনা দেখা যায়না। একদিকে প্রাপ্যতা সঙ্কট অন্যদিকে আকাশ ছোঁয়া দাম। দরিদ্র বা হত দরিদ্র, নিম্ন আয়ের লোকজন ইলিশ খেতে পারবে সেই আশা একান্তই দুরাশা।
এখন বাজারে এক কেজির ইলিশের কেজি ২ হাজার টাকা। আর ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দাম ১০০০ টাকা প্রায়।
সবমিলিয়ে এ ধরনের পরিবারগুলো যে এক বেলা ইলিশ খেতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। টাকাওয়ালাদের টাকার জোর আর তাদের কাড়াকাড়িতে তারা পেরে উঠবে না নিশ্চয়ই।
দাম বাড়ার একটি কারণ সেখানে। এই স্বাদের মাছ পেতে টাকাওয়ালারা বিক্রেতাদের হিসাবের অঙ্কের সমাধানও দিচ্ছে। এছাড়া গত তিন বছরে ইলিশ উৎপাদন কমেছে বলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তথ্য পত্রপত্রিকায় পাওয়া গেছে। চলতি ২০২৩ সাল ছাড়া এর আগের তিন বছর ধরে পর্যায়ক্রমে সাগরে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে কম। যদিও সরকার ইলিশ উৎপাদনের চেষ্টা করে চলছে।
বিভিন্ন রিপোর্টে বাংলাদেশে সহনশীল মাত্রার চেয়ে বেশি ইলিশ আহরণের কথাও বলা হয়েছে। যাতে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এই ইতিনেতির মধ্যে ইলিশ রপ্তানি নিয়ে দেশের মানুষের আপত্তিও আছে। বিশেষ করে ভারতে ইলিশ রপ্তানির ব্যাপারে।
গত জুলাইয়ে এইসময় নামে একটি পত্রিকা ইলিশের দাম সম্পর্কে শহর কলকাতা ও শহরতলির মাছ বাজারে ইলিশ বিক্রির যে দাম তুলে ধরেছে তা বাংলাদেশের সমপরিমাণের। তাদের বাজারের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ দোকানে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছে।
কলকাতার বাজারে যদি খুচরা বিক্রিতে বাংলাদেশের কাছাকাছি দামে ইলিশ বিক্রি হয়, তাহলে তা বিদেশে রপ্তানি করে কি লাভ? এই প্রশ্ন আসতে পারে স্বাভাবিকভাবেই।
এখানেই আসছে মধ্যস্বত্বভোগীদের কথা আর সিন্ডিকেটের কথা। ইলিশ রপ্তানিকারক যদি সরাসরি ঘাটের ইলিশ রপ্তানি করে তাকে মধ্যস্বত্বভোগীদের কবলে পড়তে হয় না। সেখানে তার ব্যাপক লাভ আসছে। অন্যদিকে দেশের ভেতর ঘাট থেকে ইলিশ আসতে মধ্যস্বত্বভোগী, দালাল কিংবা ফড়িয়াদের হাত হয়ে ঘুরে আসছে। যে কারণে তাদের প্রত্যেকের লাভের প্রয়োজন হচ্ছে। আর এটা বাজারে যে দাম দাঁড়ায় সেটা একমাত্র সেইসব ক্রেতাদের পক্ষে ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে।
অর্থাৎ অন্যরা কেউ এক খণ্ড ইলিশের দেখাও পাবে না। আর কারো পাতে নিত্য ইলিশ।
এছাড়া এখন যারা মাছ ধরছে – তাদের মাছ স্টক করার এখন প্রচুর সুযোগ তৈরি হয়েছে। যাতে দাম ধরে তারা সারা বছর বিক্রি করতে পারে ।
এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে শুধু ইলিশ নয় খাদ্য রপ্তানি প্রক্রিয়া সরকারের পর্যালোচনা করা দরকার। বাংলাদেশ আদৌ খাদ্য রপ্তানি করতে পারে কিনা তার জনসংখ্যা হিসাবে। যেখানে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। দেশ কোন কোন খাদ্য রপ্তানি করার উপযুক্ত- সেটি দেখা।
যাক দুঃখ ভারাক্রান্ত বা মন খারাপের কিছু নেই।ইলিশের নাম শুনলেই নাকি শত দুঃখে থাকা বাঙালির মন ভালো হয়ে যায়। তা ইলিশের কথাই তো পাড়লাম এতক্ষণ ধরে। নিশ্চয়ই ইলিশ পাতে না উঠার খেদ ঘুচে যাবে।
Discussion about this post