খুব নিরীহ আর ধীরস্থির পাখি হাঁড়িকুড়ি বা কানকুয়া। এক সময় গ্রামে বাড়ির কাছাকাছি বা মানুষের পাশাপাশি জঙ্গলে প্রায়ই দেখা যেত এই পাখিটি। নাম হাঁড়িকুড়ি বা কানকুয়া । তার শরীরের চেয়েও বেশি চোখে পড়ত চোখ জোড়া। দূর থেকে দেখলে টকটকে লাল চোখ(তবে মনি কালো)। পাখা দুটো লালচে। আগাগোড়া শরীর ঢেকে রাখে। তবে পাখার গোড়া থেকে উপরের দিকে মাথা সহ সর্বত্র কালো। কালো রংটা ছড়িয়ে আছে তার বুক জুড়ে, সারা শরীরে। শুধু বড় লালচে পাখার কারণে শরীরের উপরের অংশ কালো দেখায় না। পাখা দুটো লেজ অবধি গিয়ে প্রায় মিলে গেছে। সেখানে লালের সাথে কালো মিলেমিশে গেছে।
তবে লাল চোখে যেন কষ্ট, ব্যথা আর বেদনায় ভরা। এটার কারণ আছে- তার ডাকে আর্তনাদ শোনা যায়। নিস্তব্ব সময়ে সে ডাক পাড়ে। যখন পরিবেশ নিরব হয়ে উঠে। গরমের দুপুরে, বা বিকেলের দিকে। অন্যান্য সময়েও তার ডাক শুনা যায়। তবে রাতে ডেকে ডেকে উঠে। এটিকে প্রহর পাখিও বলা হয়। কারণ ডাক পাড়ার একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। পুত পুত করে ডাক পাড়ে বলে তার ডাকে কষ্ট অনুভূত হয়। তবে যারা এই কানকুয়ার গল্প শুনেনি, তারা কষ্ট বুঝবে না। গামে গ্রামে পুত পুত ডাকটার একটা গল্প আছে। কোনো কান্নার রোল। যার ছেলেকে ভাটা টেনে গিয়ে গেছে। আর ফিরে আসেনি। চট্টগ্রামে এই গল্পে বলা হয়- ভাইট্যা গেলি, জোয়ারইয্যা ন আলি…… পুত পুত পুত পুত (ভাটায় গেলি/ জোয়ারে আর ফিরে আসলি না)। এটাই সেই গল্প। যারা কানকুয়ার এই গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছে – তাদের কাছে কানকুয়ার মুখ কষ্টে শোকাচ্ছন্ন মনে হবে। পুত্রশোকের কষ্ট।
কানকুয়া প্রায় দাঁড়কাকের মত আকার। স্ত্রী পাখি পুরুষের তুলনায় আকারে বড় হয়। দৈর্ঘ্যে ৩৩ থেকে ৩৬ সেমিটারের কাছাকাছি। লেজের দৈর্ঘ্য ২৪ সেমি.। ওজন ৯০ গ্রামের কাছাকাছি। পা ও নখ কুচকুচে কালো।
এই পাখি এমন অবস্থায় থাকে – মানুষের খুব কাছে। আবার মানুষ থেকে অনেক দূরে। ডোবার যে পারে মানুষের চলাচল থাকে তার আশে নয় থাকবে ডোবার ওপারে। দেখতে পারবে। কিন্তু ডোবা মাড়িয়ে কে তাকে তাড়া করবে বা ধরতে যাবে। এ রকমই সতর্ক পাখি সে। এরপরও তাড়া খেলে উড়ার কোনো গরজ বোধ করে না। লাফিয়ে লাফিয়ে ঝোঁপের আড়ালে গা ঢাকা দেয়। অর্থাৎ খুব প্রয়োজন না হলে উড়াউড়িতে নই। অনেকটা অলস প্রকৃতির। আর দেখতে সুন্দর নয় বলে তেমন আকষর্ণের নয়। কিন্তু তার চোখগুলোর জন্যই এটি অন্য সব পাখি থেকে ব্যতিক্রম। অনেক দূর থেকে লাল চোখ দেখা যায়।
গাছের উপর নয়- সব সময় গাছগাছালির ঝোঁপে মাটিতে বিচরণ করে। তার খাবার খুঁজে ফেরে। মাটিতে উপরে থাকলে বড়জোর ২ গজ উপরেই থাকে। না সারাক্ষণ মাটিতে ঘোরে। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে বিচরণ করে। নানা গোকা মাকড়, ডিম ্ঁইদুর, অন্য পাখির বাচ্চা, সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী তার খাদ্য। অন্য পাখিদের প্রতি তার আচরণ রুঢ় হয়। তাদের বাসা ভেঙ্ড়ে তছনছ করে। ডিম, বাচ্চা খাওয়ার জন্য হানা দেয়।
কোন কোন এলাকায় এই পাখি আরও একটি কথা শোনা যেত। এই কানকুয়া দিনের শুরুতে দেখতে অমঙ্গল হয়। মানে ওই দিন শুভ দিন নয়। আর দেখতেও তেমন আকর্ষণীয় না হওয়ায় মোটামুটি মানুষের কাছ থেকে নিরুপদ্রব থাকতে পারে কানকুয়া। ঝোঁপের উপরে বাসা বানায়।
এই পাখি কোকিল পারিবারের সদস্য। আগে প্রায়ই দেখা যেত। কিন্তু এখন এটি গ্রামের ঝোঁপে জঙ্গলে চোখে পড়ে না। চট্টগ্রামে এটিকে হাঁড়িকুড়ি বলে। এছাড়া অঞ্চলভেদে কুক্কাল, কুবো, কানকোকা নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম: খবংংবৎ ঈড়ঁপধষ, বৈজ্ঞানিক নাম ঈবহঃৎড়ঢ়ঁং নবহমধষবহংরং.
Discussion about this post