বিদ্রোহ, বিপ্লব, সাম্য ও সম্প্রীতির মন্ত্র হৃদয়ে ধারণ জন্য কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার জীবন ব্যাপি শিল্প ও সাহিত্যসাধনা করে গেছেন। তিনি সারা জীবন ভারতবাসীর জন্য, বাংলার জন্যই সব করেছেন। ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাত থেকে ভারতের মুক্তি চেয়েছিলেন। এজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য। এই ঐক্য স্থাপনে তিনি অবিরাম লিখেছেন। সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। তিনি না ছিলেন ব্রিটিশের প্রিয় পাত্র। না ছিলেন হিন্দু- মুসলমানের এক তরফা স্বজন-প্রিয়জন। তার জনপ্রিয়তা ছিল শ্রমিক-মজুরদের কাছে। তারাই কবিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। তারা কবির জন্মদিনও উদযাপন করতেন। কৃষক, শ্রমিক, মজুরদের সাথেই তিনি সবচেয়ে বেশি অন্তরঙ্গ ছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি যখন কৃষ্ণ নগর এসেছিলেন সপরিবারে তখন তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক-শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করেন। শুধু কবিতা আর বক্তৃতা দিয়েই নয় তিনি গ্রামে গ্রামে স্বেচ্ছাসেবি বাহিনী গড়ে তুলতে কাজ করেন। তাদের কুচকাওয়াজ শেখাতেন।
নজরুল তার সৈনিক জীবনে রাজনীতির অনেক রূপই দেখেছিলেন। রুশ বিপ্লব থেকে শুরু করে তুরস্কের রাজনৈতিক নানা ঘনঘটা। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নানা সংহার ও ধ্বংসের চিত্র তাকে উন্মন করে তুলেছিল।
তিনি স্বরাজ আন্দোলন থেকে যেমন উদ্দীপনা খুঁজেছেন তেমনি কবিতা লিখেও গান্ধির ও স্বরাজের সাথে যুক্ত থেকেছেন। তবে তিনি অহিংস ও স্বরাজে মুক্তির আশা করতেন না। চিত্ত রঞ্জন দাশের রাজনৈতিক মতাদর্শেও তাকে আকৃষ্ট করেছিল। সবকিছু মিলে ২০ শতকের ২০ এর দশক সরাসরি রাজনীতির একটি অনন্য সময় নজরুলের। শুধু লেখালেখির কারণে নয়, এ সময় রাজনীতিতে জড়িয়ে তাকে জেলে যেতে হয়েছে। জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। তিনি ভারতীয় জাতিকে পৃথিবীর মধ্যে স্বাধীন ও শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন।
হুগলিতে থাকার সময় ১৯২৩ সালে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আর ১৯২৪ সালে হুগলিতে গান্ধির সাথে তার একটি সভায় দেখা হয়। ১৯২৫ সালে তিনি কংগ্রেসের সদস্য হন। এরমধ্যে তিনি তার সমমনা ও মতাদর্শিদের নিয়ে ১৯২৫ সালে শেষদিকে লেবার স্বরাজ পার্টি গঠন করেন। যেটি তখন জাতীয় কংগ্রেসের একটি দল ছিল।
তিনি ১৯২৬ সালের রাজনৈতিক ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভ্য হন। এ বছর কলকাতায় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গাও হয়। নজরুল লিখেছেন তিনি এমন দাঙ্গা জীবনে দেখেননি। সে বছর তিন দফা দাঙ্গা হয়েছিল। সেই দাঙ্গায় ঠাকুরের বাড়িও হিন্দুরা আক্রমণ করেছিল মুমলমানদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য। নজরুল তখন দাঙ্গার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবি বাহিনী গড়ে তুলেছেন। এই সময়ে তিনি লিখেন- ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? জিজ্ঞাসে কোন জন?’ জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। যুক্ত হন বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলনের মঞ্চে। আবার এ বছরই তার পুত্র বুলবুলের জন্ম।
কংগ্রেসের স্বরাজ দল থেকে ১৯২৬ সালে ঢাকা বিভাগ(ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ) থেকে কেন্দ্রিয় আইন সভার নির্বাচনে প্রার্থী হন তিনি। তখন মুসলমানদের জন্য দুটি আসন ছিল। মুজাফফর আহমদ তার নজরুল স্মৃতি কথায় লিখেছেন- ‘নজরুলের অবিবেচনার কাজের মধ্যে এটা একটা’। সেখানে তার ভোটার শুধু মুসলমানরা। প্রত্যেক ভোটারের দুটি ভোট। ১৮১১৬ জন ভোটার ছিল। সম্পত্তির ভিত্তিতেই তখন ভোটার হবার সুযোগ ছিল। তাকে আর্থিক সহায়তা করেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়। তিনি তাকে তিনশ টাকার চেয়ে বেশি টাকা দেন। যা তিনি একদিনেই রোগী দেখে আয় করেছেন বলে মনে করেন মুজফফর আহমদ। এছাড়াও নজরুল আরও কিছু টাকা যোগাড় করেন। কিন্তু যে নির্বাচনে হাজার হাজার টাকা খরচ সেখানে নজরুলের এই সামান্য টাকায় কি হবে।
নির্বাচনে তার সাথে প্রার্থি ছিলেন বরিশালের জমিদার মুহাম্মদ ইসমাইল চৌধুরী, আবদুল হালিম গজনবী, আবদুল করিম, মফিজ উদ্দিন আহমদ। কিন্তু নজরুল নির্বাচনে হেরে জামানত হারান। তাকে তার শুভাকাক্সক্ষাীরা বলেছিলেন, আপনার একটা মান সম্মান আছে। নির্বাচন থেকে পিছু হঠার জন্য বলেছিলেন। প্রথমবার তাদের কথামত নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিলেও কিন্তু পরে নির্বাচনে অংশ নেন এবং হেরে যান।
Discussion about this post