চট্টগ্রাম, ২ অক্টোবর, ২০২২:
বাংলাদেশের বিমানবন্দর দিয়ে আসা এত স্বর্ণ যাচ্ছে কোথায়?দেশে বৈধপথে আমদানি ও চোরাচালানের মাধ্যমে প্রতিবছর যে পরিমাণ স্বর্ণ আসে, অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা তার একশ’ ভাগের এক ভাগও নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন যেখানে দেশে স্বর্ণের চাহিদাই কম সেখানকার স্বর্ণ অন্য কোথাও পাচার হচ্ছে। সে হিসাবে তাদের বক্তব্য হচ্ছে স্বর্ণ যাচ্ছে ভারতে। কারণ ভারতের বাজারে চাহিদার বড় অংশই জোগান দেয়া হয় পাচারের স্বর্ণ দিয়ে।
এর কারণ হচ্ছে, ভারতে বৈধপথে স্বর্ণ আমদানিতে উচ্চ শুল্ক ধার্য রয়েছে। শুল্ক ফাঁকি দিতেই বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে চোরাকারবারি চক্র।
স্বর্ণের কারবার কিংবা জুয়েলারি ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বেশকিছু গবেষণা ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত দিয়ে ভারতে স্বর্ণ পাচার বা চোরাচালানের বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে। ভারতের চাহিদার বড় অংশই জোগান দেয়া হয় পাচারের স্বর্ণ দিয়ে।
তথ্যমতে, বর্তমানে ভারতে স্বর্ণ আমদানিতে সাড়ে ১২ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এছাড়া বৈধভাবে স্বর্ণ বিক্রিতে পরিশোধ করতে হয় আরও তিন শতাংশ জিএসটি বা জেনারেল সেলস ট্যাক্স। তার মানে সেখানে বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি করে বিক্রি করতে গেলে সব মিলিয়ে সাড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এতে স্বর্ণের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আবার গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামও ঊর্ধ্বমুখী। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের শীর্ষ স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহারকারীর দেশটিতে ক্রেতাদের হাতে কিছুটা ছাড়ে স্বর্ণ ও অলঙ্কার বিক্রি করতে বাংলাদেশ হয়ে আনা হচ্ছে স্বর্ণ। আকাশপথে বিমানবন্দরে নিয়ে আসা অবৈধ স্বর্ণ সীমান্ত দিয়ে পাচার করা হচ্ছে ভারতের বাজারে।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, করোনার অভিঘাত স্বাভাবিক হতে শুরু করার সাথে সাথে শাহ আমানত ও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে অবৈধ পন্থার পাশাপাশি শুল্ক পরিশোধ করেও স্বর্ণ আমদানির পরিমাণ হঠাৎ করে বেড়ে যায়। গত বছরের কেবল জানুয়ারি মাসেই বিদেশফেরত যাত্রীরা বিমানবন্দর কাস্টমসে শুল্ক পরিশোধের মাধ্যমে ছাড় করিয়েছেন ১১ হাজার ৬২ পিস স্বর্ণের বার। আর ২০২০ সালের শেষ তিন মাস ও ২০২১ সালের প্রথম মাস মিলিয়ে বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণের বার ছাড় করানো হয়েছে চার মেট্রিক টন। এসব স্বর্ণের বারের সিংহভাগই নিয়ে আসেন দুবাইফেরত যাত্রীরা।করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বিভিন্ন দেশে জারি করা লকডাউন বা অবরুদ্ধ অবস্থা ধীরে ধীরে তুলে নেয়ার পর মূলতঃ গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকেই আন্তর্জাতিক রুটে সীমিত আকারে যাত্রীবাহী বিমান চলাচল শুরু হয়। এর মধ্যে গত বছরের পয়লা ও ১৫ অক্টোবর বিমানবন্দরে দায়িত্বরত জাতীয় গেয়েন্দা সংস্থা ও শুল্ক কর্তৃপক্ষ বিমানের পৃথক দুটি ফ্লাইট থেকে অবৈধ পথে নিয়ে আসা দুইশ’ ৪২ পিস স্বর্ণের দুটি চালান জব্দ করে। মূলত এরপর থেকেই বিমানবন্দর কাস্টমসে শুল্ক কর পরিশোধ করে স্বর্ণের বার ছাড় করানোর হিড়িক পড়ে। বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়জুড়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে শুল্ক পরিশোধ করে বা বৈধপথে সবমিলিয়ে একশ’ চার কেজির কিছু বেশি স্বর্ণের বার এনেছিলেন বিদেশফেরত যাত্রীরা। পরবর্তী বছরে সেখানে বৈধ উপায়ে স্বর্ণ আমদানির পরিমাণ প্রায় ৪৫ গুণ বৃদ্ধি পায়।জুয়েলারি সমিতি (বাজুস)- এর চট্টগ্রাম শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক স্বপন চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ব্যাগেজ রুলের আওতায় আনা স্বর্ণের সামান্য পরিমাণ হয়তো দেশের বাজারে আসতে পারে। তবে বাজারে চাহিদার তুলনায় এত বেশি পরিমাণে নিয়ে আসা স্বর্ণ আসলে কোথায় যাচ্ছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। বাজারে তো স্বর্ণের দামের উল্লম্ফন আর টাকার মান কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত রয়েছে।
যে কারণে
চোরাচালানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারের মত দেশের জুয়েলারি শিল্প খাতেও স্বর্ণের দামে অস্থিরতা অব্যাহত থাকার মধ্যেই বৈধপথে বা শুল্ক পরিশোধ করে রেকর্ড ছাড়িয়ে স্বর্ণের বার আমদানির প্রবণতাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে মন্তব্য করে এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, ব্যাগেজ রুলের আওতায় একজন বিদেশফেরত যাত্রী শুল্ক-কর পরিশোধের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ২০ ভরি বা দুটি স্বর্ণের বার আনতে পারেন। এ জন্য প্রতি ভরিতে (১১ দশমিক ছয়শ’৬৪ গ্রাম) শুল্ক-কর দিতে হয় দুই হাজার টাকা করে। এছাড়া স্বর্ণের বারের বাইরে একজন যাত্রী বিনাশুল্কে একশ’ গ্রাম ওজনের (প্রায় সাড়ে আট ভরি) স্বর্ণালংকার আনতে পারবেন। তবে স্বর্ণালংকারের মধ্যে একই ধরনের ১২ টির বেশি হওয়া যাবেনা। ব্যাগেজ রুলের পাশাপাশি সরকার ২০১৮ সালে প্রথমবারের মত স্বর্ণ আমদানি নীতিমালা প্রণযন করে। এ নীতিমালার আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানি করে আসছে। তবে নতুন নীতিমালার আওতায় স্বর্ণ আমদানির পরিমাণ হতাশাব্যঞ্জক বলে জানা গেছে।
Discussion about this post