উইলিয়াম এইচ. সিলভিস (William H. Sylvis) আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলনে একটি অবিস্মরণীয় নাম। তার জন্ম হযেছিল ১৮১৮ সালে পেনসিলভানিয়ার একটি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবাবে। সেই পবিবারের দশটি সন্তানের মধ্যে সিলভিস ছিলেন একজন। ১৮৫৭সালে ফিলাডেলফিয়ার লোহা ঢালাই শ্রমিকদের ইউনিয়নে যোগ দেবাব আগে বছরের পর বছব তাঁর জীবন কেটেছে একঘেযে হাড়-ভাঙা খাটুনি আর তিক্ততার মাঝে। ইউনিয়নে যোগদানের পর তিনি পেলেন এক নতুন জীবন, নতুন আশা, নতুন জীবনদর্শন। উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আমি এই ইউনিয়ন আদর্শকে ভালবাসি। আমার পরিবাব বা আমার জীবনের চেয়েও তা আমার কাছে বেশি প্রিয়। নিজেব সত্ত্বা বা পৃথিবীর কাছে আমার যা কিছু কামনা, সবকিছুই আমি এর জন্য দিতে রাজী।”
কিন্তু দারিদ্রতা ছিল তাঁর নিত্য সাথী। ঘরে প্রায়ই তাঁর পাঁচটি ক্ষুধার্ত সন্তানের অন্ন জুটত না। দুশ্চিন্তায় আর রোগে তাঁর স্ত্রী হয়ে পড়তেন দিশেহাবা। কিন্তু সেদিকে দৃষ্টিপাত করার সময় কোথায়? ইউনিয়ন গড়ার কাজে সবসময়েই ঘটনার কেন্দ্রস্থলে থাকতেন তিনি। জীবনে যেন সার্থকতার পথ খুঁজে পেলেন।
এদিকে শুরু হয়ে গেল আমেরিকার গৃহযুদ্ধ। সিলভিস বসে থাকার পাত্র নন। ঢালাই শ্রমিকদের মধ্য থেকে ইউনিয়ন সদস্যদের নিয়ে গড়ে তুললেন এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যুদ্ধে যোগদানের আশায়। তিনি নির্বাচিত হলেন একজন লেফট্যান্টের পদে। কিন্তু যুদ্ধে রওনা হবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে অত উত্তেজনার মধ্যেও তাঁর স্ত্রীর আকুতি আর অগ্রাহ্য করা গেল না। ঘরে পয়সা নেই, শিশুদের খাবার নেই। তাঁর স্ত্রী ও শিশুরা বাঁচবে কী করে? তাই ব্যান্ড বাজিয়ে সিলভিসেব বাহিনী যখন গাড়িতে উঠেছে, তখন সেনাপতিকে বিমর্ষ মনে ফিরে যেতে হ’ল ঢালাই কারখানায় ও পারিবারিক জীবনে। এটা তাঁর কাছে এক অসহনীয় ঘটনা। তিনি আবার গঠন করলেন আরেকটি বাহিনী এবং ১৮৬১ সালে পেনসিলভানিয়া যখন আক্রমণের মুখে, তখন তিনি রণক্ষেত্রে গেলেন একজন সার্জেন্ট হয়ে। কিন্তু তিনমাস পরেই আবার ফিরে আসতে হ’ল সংসারটিকে বাঁচানোর তাগিদে। তিক্তত। তাঁর সারা মনটাকে আচ্ছন্ন ক’রে দিল। বন্ধুরা সবাই চলে গেছে রণক্ষেত্রে। মাত্র দু’বছর আগে ঢালাই শ্রমিকদের যে জাতীয় ইউনিয়নটি গড়ে তোলায় তাঁর প্রয়াস ছিল নিরলস, সেই ইউনিয়নটিও গেল অদৃশ্য হয়ে, কেননা সদস্যরা সবাই গেছে যুদ্ধে।
রণক্ষেত্রে যখন অসীম বীরত্বের প্রকাশ হচ্ছে, তখন ‘তার বাইরে চলেছে অপরিসীম প্রবঞ্চনা। যখন বাপেরা, স্বামীরা, যুবকের। মরণপণ লড়াইতে ব্যস্ত, তখন হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মহিলা ও শিশুর। জীবিকার তাগিদে কাজ করতে এসেছে কারখানায়। আর, এইসব নতুন শ্রমিকদের আগের চেয়ে অনেক কম মাইনেতে খাটিয়ে মালিকেরা লুটেছে মুনাফা। যে সব শিশুদের স্কুলে যাবার কথা, তারা এসেছে কারখানায় আর কাজ করতে করতে ঘুমে এলিয়ে পড়েছে মেসিনের পাশে। মেয়েরা ভোর থেকে মাঝ-রাত পর্যন্ত খাটছে আর অজ্ঞান হয়ে পড়েছে সেইখানেই। নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউন, নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ইত্যাদি কাগজে তা পড়ে চলেছেন অসহায় নিরুপায় সিলভিস আর নিজেও দিনে ১২ ঘণ্টা ক’রে কারখানায় খেটে চলেছেন নিজের সংসারটাকে কোনোমতে টিকিয়ে রাখার তাগিদে। কিন্তু এই অত্যাচারের বন্যা বেশিদিন চলতে পারেনি। ১৮৬২ সালের শেষদিকে আবার শুরু হ’ল ধর্মঘটের জোয়ার। সিলভিস আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন সংগঠনের কাজে।
১৮৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে পিটসবার্গে সিলভিসের উদ্যোগেই পুনর্গঠিত হল ন্যাশনাল মোল্ডার্স’ ইউনিয়ন। সিলভিস হলেন সভাপতি এবং এই কাগুজে সংগঠনটিকে জীবন্ত ক’রে তোলার ভার পড়ল তাঁর ওপর। আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম সারাদেশ ঘুরে জাতীয় সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা। মাত্র ১০০ ডলার হাতে নিয়ে প্রায় দশ হাজার মাইল পরিক্রমার চেষ্টা হ’ল। টাকা ফুরিয়ে গেছে, তবু এক শহর থেকে অন্য শহরে বহন ক’রে নিয়ে চলেছেন ইউনিয়নের আদর্শ।
কখনো রেলপথের ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে প্রার্থনা করেছেন বিনা ভাড়ায় চলাচলের জন্য, কখনো থেকেছেন অভুক্ত আর ছেঁড়া জামাকাপড় পরেই কাটিয়েছেন সারা পথটা। পরবর্তীকালে নিজেই বলেছেন, তিনি কোনোদিনই এত সুখী হননি, কেননা বহুদিন ধরে তিনি যা করতে চেয়েছেন, তা করছিলেন সেই সময়।
তিনি শুধু প্রথম জাতীয় ইউনিয়নগুলির মধ্যে একটির প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, প্রথম জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন তিনি। যে সব নীতির জন্য তাঁকে সারা জীবন লড়তে হয়েছে, তার মধ্যে ছিল: নিগ্রো শ্রমিকদের সাথে সংহতি, সমান কাজের জন্য মেয়েদের সমান মজুরি, ট্রেড ইউনিয়নে মেয়েদের প্রবেশাধিকার, শ্রমিক, কৃষক ও নিগ্রোদের স্বাধীন রাজনৈতিক কর্ম এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি। একদিকে প্রচণ্ড দারিদ্র্য আর অন্যদিকে প্রবল কর্ম-প্রেরণা, উদ্যম ও প্রচেষ্ট। এই দুটোর মিলনেই তাঁর মৃত্যু হ’ল মাত্র ৪১ বছর বয়েসে।
১৮৬৬ সালের অগাস্টে বাল্টিমোরে ৬০টি ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা যে ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন গঠন করে, সেটাই আমেরিকার ইতিহাসে শ্রমিকদের প্রথম জাতীয় ফেডারেশন। তার উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সিলভিস। সেই প্রতিষ্ঠা সম্মেলনই নিয়েছিল আট-ঘণ্টার দাবির ঐতিহাসিক প্রস্তাব:
“এই দেশের শ্রমিককে পুঁজিবাদী দাসত্বের হাত থেকে মুক্ত করার
জন্য, বর্তমানের প্রথম ও বিরাট প্রয়োজন এমন একটা আইন পাশ করা, যার ফলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত রাজ্যগুলিতে আট ঘণ্টাই যেন স্বাভাবিক কাজের দিন বলে গণ্য হতে পারে। যতদিন এই গৌরবময ফল অর্জন করতে না পারি, ততদিন আমরা আমাদের সর্বশক্তি নিযোগের সংকল্প নিচ্ছি।”
তা ছাড়া, “শিল্পে নিযুক্ত শ্রেণীগুলির স্বার্থরক্ষা ও প্রতিনিধিত্ব করার সংকল্পে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ব্যক্তিদের নির্বাচনে’র জন্য স্বতন্ত্র রাজ-নৈতিক আন্দোলনের প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয় ঐ সম্মেলনে।
তবু ঐ সম্মেলনে সিলভিস ব্যর্থ হলেন নিগ্রো-শ্রমিক সংহতির প্রশ্নে। নিগ্রোদের সম্পর্কে তিনি লিখলেন, “আমরা যদি আমাদের
সাথে এই লোকদের সমস্বার্থের কথা বোঝাতে সমর্থ হই আমরা পাব একটা শক্তি যা ওয়াল স্ট্রিটের পায়ের তলা কাঁপিয়ে তুলবে।” ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “সঙ্গীহীনা বিধবা বা সাদা চামড়ার সুদক্ষ মিস্ত্রি বা অজ্ঞ কৃষ্ণকায়-অন্যায় যার প্রতিই হোক না কেন, লুণ্ঠনকারী ও লুণ্ঠিতের মধ্যেই আছে পার্থক্যের সীমারেখা। পুঁজি কখনো ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা করে না এবং তার স্বরূপটাই এমন যে শ্রমিক শ্রেণীর সবাইকে হেয় না করে মাত্র তার একাংশকে হেয় করা নিছক অসম্ভব।”
কিন্তু বাল্টিমোরে যে প্রতিনিধিরা জড়ো হয়েছিলেন, তাঁদের মনে এই যুক্তি বিশেষ কোনো নাড়া দিল না, কেননা অধিকাংশের মনেই নিগ্রোদের সম্পর্কে তখনো রয়েছে প্রবল কুসংস্কার।
১৮৬৭ সালে “আমেরিকার ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের” কাছে আবারো একটি আবেদনে লিখলেন, “নিগ্রোরা সংখ্যায় চল্লিশ লাখ এবং দুনিয়ার ঐ সংখ্যক যে কোনো জনসমষ্টির চেয়ে বেশি সংখ্যায় এরা হাতের কাজ করে। আমরা কি তাদের প্রদত্ত সহযোগিতাকে বর্জন করতে ও তাদের শত্রু বলে গণ্য করতে পারি? এমন নির্বোধের কাজ করলে শ্রম-সংস্কারের উদ্দেশ্যকে পুঁজির সম্মিলিত প্রচেষ্টা যে
আঘাত হানে, তার চেয়েও গুরুতর আঘাত আমরাই হানবো। তাই উত্তরের ও দক্ষিণের পুঁজিপতিরা শ্বেতকায় ও কৃষ্ণকায়ের মধ্যে সংঘাতকে উস্কে দেবে এবং একজনকে লাগিয়ে দেবে অপরের বিরুদ্ধে, নিজেদের ক্রমোন্নতিকে রক্ষা করার এবং অত্যাচারের রাজত্বকে বজায় রাখার স্বার্থ ও সুযোগের প্রয়োজনে।”
ঐ একই সময়ে তিনি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে মেয়েদের যোগ দেবার অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও সমানে চালিয়ে গেছেন:
“যারা মজুরি-মানে সমতা রক্ষার জন্য ও শ্রমের মর্যাদার জন্য লড়াই করছে, সেই আমরা নারী শ্রমিকদের ও নিজেদের অধিকারকে পাহারা দেওয়া ও রক্ষা করার জর মানবতার কাছে না হলেও অন্তত যৌক্তিকতার কাছে ঋণী। যে সামাজিক বিকাশ আমাদের সকলেরই লক্ষ্য, ভার অগ্রগতিতে আমাদের সাথে নারীদের সহচরী না ক’রে আমরা কেমন ক’রে সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর আশা করতে পারি ?”
গৃহযুদ্ধের সময় গৃহস্থালীর পরিবর্তে মেয়েরা বিপুল সংখ্যায় যোগ দিয়েছিল কল-কারখানায় আর সামান্য মজুরিতেই তারা কাজ করত। ফলে, মজুরির হার গিয়েছিল কমে। সেই কারণে অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়নই ছিল নারী শ্রমিকের বিরুদ্ধে। কিন্তু সিলভিসের নেতৃত্বে অবশেষে নারী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন সদস্যপদ দেবার ও সম্মেলনে -তাদের প্রতিনিধি পাঠানোর নীতি, সমান কাজের জন্য সমান বেতন ও মেয়েদের জন্য আট ঘণ্টা কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়া হ’ল ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়নে।
১৮৬৭ সালের সম্মেলনে নিগ্রোদের সদস্যপদ লাভের অধিকারকে আবারো এড়িয়ে যাওয়া হ’ল। ১৮৬৮ সালের সম্মেলন যদিও সিলভিসকে সভাপতির পদে নির্বাচিত করল, নিগ্রোদের প্রশ্নটি কিন্তু বাদ হয়ে গেল। ১৮৬৯ সালের সম্মেলনের ঠিক প্রাক্কালে মাত্র ৪১ বছর বয়সে সহসা মারা গেলেন সিলভিস। অথচ ১৮৬৯ সালের সম্মেলনটিই সিলভিসের গৌরবকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। জীবিত
অবস্থায় সহকর্মীদের কাছে যে নীতি বোঝাতে তিনি অক্ষম হয়েছিলেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন হৃদয়ে তাঁরা সেকথা বুঝলেন এবং প্রস্তাবে ঘোষণা করলেন: “শ্রমিকদের অধিকারের প্রশ্নে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, শ্বেতকায়-কৃষ্ণকায় বা স্ত্রী-পুরুষ কোনো ভেদই জানে না ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন এবং আমাদের কৃষ্ণকায় সহকর্মীদের কাছে সমস্ত বৈধ উপায়ে সংগঠন গড়ার ও পরবর্তী কংগ্রেসে প্রত্যেক রাজ্য থেকে ইউনিয়নের প্রতিনিধি পাঠানোর অনুরোধ জানাচ্ছে।”
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতির প্রচেষ্টাও সিলভিসের জীবনে এক বিরাট কীর্তি। তিনি চেষ্টা করছিলেন ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়নকে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতির (International Workingmen’s Association) অন্তর্ভুত করতে। অবশেষে তাঁরই প্রভাবে ১৮৬৭সালে ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিকের পরবর্তী কংগ্রেসে যোগদানের জন্য ট্রেভেলিককে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়।
আরো উল্লেখযোগ্য, ১৮৬৮ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে এই ইউনিয়নের তৃতীয় কংগ্রেসে একটি স্বতন্ত্র শ্রমিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং দাবি করা হয়: যারা চাষ করে, শুধু তাদের
হাতেই জমি দিতে হবে, শ্রমিক দপ্তর গঠন করতে হবে, আট-ঘণ্টা কাজের দিন সম্পর্কে আইন এবং স্ত্রী-পুরুষের সমানাধিকার মানতে হবে। ঐ কংগ্রেস থেকে আন্দোলনে যোগদানের জন্য নিগ্রোদের কাছে আহ্বান জানানো হয়। ১৮৬৯ সালে সাধারণ পরিষদের আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিকের বেল কংগ্রেসে প্রতিনিধি পাঠানোর প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সহসা সিলভিসের মৃত্যু হয় এবং তার জায়গায় শিকাগো থেকে প্রকাশিত ‘ওয়ার্কিং মেনস অ্যাডভোকেট’ পত্রিকার সম্পাদক এ. সি ক্যামেরন ও লুকার প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হন। সিলভিসের মৃত্যু-সংবাদ পাওয়ার পরেই আন্তর্জাতিকের পক্ষ থেকে ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়নের সদস্যদের কাছে এক শোক-বার্তা পাঠানো হয়:
“শুভ আদশে অনুপ্রাণিত একজন বিশ্বস্ত, অধ্যবসায়ী ও ক্রান্তিহীন কর্মী, আপনাদের সম্মানিত ও যোগ্য সভাপতি উইলিয়াম এইচ. সিলভিস-কে মৃত্যু আপনাদের মধ্য থেকে এত অপ্রত্যাশিতভাবে ও অকালে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল, সেই দুঃসংবাদ আমাদের মনকে অবর্ণনীয় শোক ও দুঃখে আচ্ছন্ন করেছে। জীবনের চরম দীপ্তিয় সময় তাঁর মতো পরীক্ষিত সংগ্রামীদের হারানো শ্রমজীবী ভাই ও বোনেদের সংহতির কাছে অসহনীয়, সেই ক্ষতির শোকে আমরাও সমানভাবে মর্মাহত। যদিও যোগ্য পরামর্শদাতা ও পরীক্ষিত নেতাদের যথেষ্ট প্রাচুর্য নেই, তবু আপনাদের সদস্যদের মধ্যে তাঁর পরিবর্তে কাজ চালিয়ে যাবার মতো ইচ্ছুক ও যোগ্য লোক আছেন এবং তাঁদের একই রকম উদ্দীপনা ও নিষ্ঠা আছে, এটা জেনে আমরা সান্ত্বনা পাই। আমরা আগে থেকেই নিশ্চিত যে আপনাদের বর্তমান অধিবেশন যথাযথ পদের জয় যথোপযুক্ত লোক নির্বাচন করবেন এবং বিরাট সংগ্রামকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাবার ও তাঁর সাফল্যকে সৃনিশ্চিত করার সেহায়ক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
তা ছাড়া, আন্তর্জাতিকের চতুর্থ বার্ষিক কংগ্রেসে মার্কসের লেখা সাধারণ পরিষদের যে রিপোর্ট’টি পেশ করা হয়, তাতে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর শেষ চিঠিখানার উদ্ধৃতি ছিল। সিলভিসের সেই চিঠিখানাও ছিল অনবদ্য:
“ঠিকানা সহ আপনার ১২ তারিখের চিঠিখানা গতকাল আমার কাছে এসে পৌঁচেছে। সমুদ্রের ওপার থেকে আমাদের সাথী শ্রম-জীবীদের এমন সহৃদয় বার্তা পেয়ে আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছি: আমাদের উদ্দেশ্য অভিন্ন। এটা হল দারিদ্র্য ও সম্পদের মধ্যে লড়াই: দুনিয়ার সব প্রান্তেই শ্রমের সমান হীন অবস্থা আর পুঁজির একই অত্যাচারী রূপ। তাই আমি বলি, আমাদের উদ্দেশ অভিন্ন। আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে আপনি যাদের প্রতিনিধি, তাদের সবাইকে আর ইউরোপের সমস্ত পদদলিত ও নিপীড়িত খেটে-খাওয়া ছেলেমেয়েদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমজীবীদের
পক্ষ থেকে আমি বাড়িয়ে দিচ্ছি সহযোগীর ডান হাত। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনাদের প্রচেষ্টা চরম গৌরবোজ্জস সাফল্য অর্জন না করে, আপনাদের আরদ্ধ শুভ কর্মে আপনারা এগিয়ে চলুন। সেটাই আমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। আমাদের বিগত যুদ্ধের ফলে পৃথিবীর বুকে তৈরি হয়েছে অত্যন্ত জঘণ্য অর্থাশ্রয়ী আভিজাত্য। এই অর্থ-শক্তি জনগণকে দ্রুত নিঃশেষ ক’রে দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি এবং আমরা জিততে চাই। যদি পারি, ব্যালট-বাক্সের মাধ্যমেই জিতব; তা না হলে কঠোর পন্থা নেব। বেপরোয়া পরিস্থিতিতে কিছুটা রক্তক্ষরণও কখনো কখনো প্রয়োজন।”
সিলভিসের মৃত্যুর পর তাঁকে কবর দেওয়ার অর্থও ছিল না তাঁর পরিবারের হাতে, ধার করেই সে কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছিল। তাঁর জীবনে ছিল প্রচণ্ড দারিদ্র্য আর ছিল আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি অসীম ভালবাসা। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি নিজেই বলেছিলেন, “মানবতা ও সমাজ-সংস্কারের স্বার্থে আমার বিনীত প্রচেষ্টাকে সর্বত্র আমার সাথী শ্রমজীবীরা যে স্বীকৃতি দিয়েছেন, তা জানতে পারা আমার কাছে আন্তরিক গর্বের বিষয়।”
তাঁর মৃত্যুর পরেই ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়নের আয়ু ক্ষীণ হয়ে এল, বিশেষ ক’রে ট্রেড ইউনিয়ন নীতির থেকে বিচ্যুতির ফলে। ১৮৭২ সালের সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মাত্র সাতজন প্রতিনিধি। তারপর থেকে আর কোনো সম্মেলন হয়নি। কিন্তু যে আন্দোলন ও নীতির জন্য তিনি আজীবন লড়েছেন, তার কোনো ক্ষয় নেই।
ফেডারেশন-নাইটস অব লেবার (Knights of Labor) নামে পরবর্তীকালে সেই ফেডারেশনই শ্রমিক শ্রেণীর বিপুল শক্তির আধার হয়ে দেখা দিয়েছিল।
Discussion about this post